বঙ্গ বিজেপির কোন্দল আর অন্দরে নেই। একেবারে প্রকাশ্যে। আবার এরাজ্য থেকে দলের একমাত্র কেন্দ্রীয় পদাধিকারী প্রকাশ্যে নেমে পড়েছেন বঞ্চিত, অবহেলিত, বসে যাওয়া কর্মীদের সমর্থনে। তাঁদের অনুষ্ঠানে হাজির থাকছেন। এরই মাঝে একদফা বঙ্গ বিজেপির মুখ্য মুখপাত্রের সঙ্গে কটাক্ষ-পাল্টা কটাক্ষ হয়ে গেল কেন্দ্রীয় নেতার। শমীক ভট্টাচার্য বনাম অনুপম হাজরা। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে কেন বাংলায় বিজেপির মধ্যে এই প্রকাশ্য-সংঘাত? তবে রাজনৈতিক মহল এর মধ্যে পদ্মশিবিরের রণকৌশল দেখতে পাচ্ছে।
দীর্ঘ সময় দিল্লিতে থাকার পর বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক অনুপম হাজরা বাংলার রাজনৈতিক ময়দানে নেমে পড়েছেন। অনুপম প্রকাশ্যেই বসে যাওয়া বিজেপি কর্মীদের পাশে রয়েছেন বলে ঘোষণা করেছেন। কার্যত রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন প্রাক্তন সাংসদ। পরিস্থিতি দেখে মনে হতেই পারে বঙ্গ বিজেপির ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গে যেন বসে যাওয়া কর্মীদের সংগঠিত করতে কেন্দ্রীয় নেতা অনুপমের লড়াই শুরু হয়েছে। কিন্তু আদৌ কি এটা শুধু বিজেপির অন্দরের সংঘাত?
৪ বছর আগে ফিরে গেলে দেখা যাবে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ১৮টি আসন পেয়ে রাজনৈতিক মহলকে চমকে দিয়েছিল বিজেপি।
তারপর ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বঙ্গজয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে গেরুয়া শিবির। বেশিরভাগ নেতার শারীরিক ভাষা বদলে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন ক্ষমতায় চলেই এসেছে। ২০০ আসনের লক্ষ্যে নেমে ৭৭-এ থামতে হয় পদ্মশিবিরকে। ২০২১-এ নির্বাচনের পর থেকেই সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হতে থাকে বিজেপি। রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হয়েও নেতৃত্বের সাহায্য মেলেনি স্থানীয় নেতা থেকে কর্মীদের, রাজ্যের সর্বত্র এই অভিযোগ ওঠে। ধীরে ধীরে বসে যাওয়া নেতা-কর্মীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। সামনেই লোকসভা নির্বাচন। অবশেষে টনক নড়েছে কেন্দ্রীয় বিজেপির। ভোট বড় যে বালাই।
ইতিমধ্যে এরাজ্যে এসে ৩৫টি লোকসভা আসনের লক্ষ্যমাত্রার কথা বলে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। পদ্মশিবিরের ছোট-বড় নেতৃত্ব সকলেই অবগত এই মুহুর্তে এরাজ্যে সংগঠনের যা পরিস্থিতি তাতে ওই ৩৫টি আসনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সোনার পাথরবাটি ছাড়া কিছুই নয়। এখন হিসেব-নিকেশ চলছে লোকসভায় কে কোথায় দাঁড়াবেন। কে কাকে আটকাবে সেই অঙ্কে চলছে খেলা।
অনুপম হাজরার দুটো ফেসবুক পোস্টে কি লিখেছেন দেখা যাক। দু'দিন দিন তিনি আগে লিখেছেন, 'খয়রাশোল পৌঁছাবার পর আমার ওপরে আবার আক্রমণ, সৌজন্যে অমিতাভ চক্রবর্তী ঘনিষ্ঠ ধ্রুব সাহা এবরং অনুপ সাহার তৃণমূল আশ্রিত ভাড়াটে মাতাল ও লেঠেল বাহিনী।' তারপরের পোস্ট, 'বসে থাকা, কোণঠাসা, বসিয়ে রাখা কার্যকর্তাদের মনোবল চাঙ্গা করার কর্মসূচি আগামী দিনেও চলতে থাকবে। যে সমস্ত জেলা থেকে যোগাযোগ করছেন, আগামী পরশুর মধ্যে সব ডেট নিশ্চিত করা হবে।' অভিযোগ, খয়রাশোলে অনুপমদের অনুষ্ঠান মঞ্চ ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে বিজেপির আর এক গোষ্ঠী। তবে বঙ্গ বিজেপির এই লড়াইতে কোনও পক্ষে নেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
এরই মধ্যে কোথাও রাজ্যের সাংগঠনিক সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী, কোথাও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুভাষ সরকার কর্মীদের ক্ষোভের মুখে পড়েছেন। জেলা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দলের বিরোধী গোষ্ঠীর ক্ষোভ তো নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে অনুপম হাজরা সরাসরি ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের পাশে থেকে অনুষ্ঠানেও অংশ নিচ্ছেন। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশ ছাড়া কখনও সর্বভারতীয় সম্পাদক এভাবে কর্মসূচি নিতে পারে না। দলের একাংশ তো অনুপমকে সাসপেন্ড করার কথাও বলছেন।
অনুপমকে সাসপেন্ড করার আদৌ কি কোনও ক্ষমতা আছে রাজ্য নেতৃত্বের? দিনের পর দিন বসে যাওয়া অবহেলিত বিক্ষুব্ধ কর্মীদের পাশে অনুপমের থাকার কারণ কি? এক্ষেত্রে রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, এই মুহূর্তে দলের এই ধরনের নেতা-কর্মীদের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ। এখনও এই নেতা-কর্মীরা দল ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস বা অন্য কোনও দলে যোগ দেয়নি। তাঁদের ক্ষোভ রাজ্য নেতৃত্ব বা কোথাও জেলা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে।
কয়েক মাস আগে তো বিভিন্ন সাংগঠনিক জেলায় পদত্যাগের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। লোকসভা নির্বাচনে লড়াই করতে গেলে এই অংশের সমর্থন অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এঁরা যাতে দল পরিবর্তন না করে, দলের একাংশ অন্তত তাঁদের পাশে আছে সেই বার্তা দিতেই কেন্দ্রীয় নেতা সঙ্গ দিচ্ছেন। মোদ্দা কথা ক্ষুব্ধ হলেও দলের মধ্যে আটকে রাখার কৌশল।
আরও পড়ুন- বেড়েই চলেছে শিশুর অসুস্থতা, বারবার ‘বেড নেই’ বলে ‘মুখঝামটা’ SSKM-এর, দিশেহারা পরিবার
দীর্ঘ সময় ধরে রাজ্য বিজেপির তেমন বড় কর্মসূচি নেই। এখন রাজ্যের পর্যবেক্ষক সংগঠনে কি ভূমিকা পালন করছেন? তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে দলের অন্দরে। প্রতিটি জনসভায় মুকুল রায়ের সঙ্গে কানে কানে ফুসফুস করে কথা বলা তৎকালীন পর্যবেক্ষক কৈলাশ বিজয়বর্গীয়র বিরুদ্ধে কলকাতা জুড়ে পোস্টার পড়েছিল। রাজনৈতিক মহলের মতে, ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের পর এরাজ্যে আর পা রাখার সাহস দেখাননি কৈলাশ বিজয়বর্গীয়।
গরুপাচার থেকে কয়লা পাচার, শিক্ষা ও পুরসভায় নিয়োগ দুর্নীতি থেকে রেশনের কালা কারবার নিয়ে তোলপাড় রাজ্য। তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক মন্ত্রী, বিধায়ক, নেতা জেলবন্দি। অন্যদিকে বগটুই গণহত্যা, আনিস খান মৃত্যু রহস্য, হাসখাঁলি ধর্ষণ-খুন-সহ নানা ঘটনায় রাজ্যে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে নানা ইস্যু থাকলেও যেন ঘর গোছাতে পারছে না পদ্মশিবির। পদ্মের খসতে থাকা পাপড়ি জুড়তে তাই কি ময়দানে পাঠানো হয়েছে অনুপমকে? সেই চর্চাই চলছে রাজনৈতিক মহলে।