ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি প্রেসিডেন্সি কলেজে। তখন নকশালদের রীতিমতো দাপট। পরবর্তীতে কংগ্রেসের হাত ছেড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ। বিধায়ক নির্বাচিত হয়েও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দল ছাড়েন তিনি। কংগ্রেসে ফিরে যান তিনি। এই বিশিষ্ট আইনজীবী রাজ্য বার কাউন্সিলের সভাপতি। পরাজিত করেছেন তৃণমূল ও বিজেপির সমর্থনে প্রার্থীদের। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, সিপিএম সম্পর্কে চাঁচাছোলা মন্তব্য করলেন অরুণাভ ঘোষ। জানালেন কংগ্রেসের হালহকিকত।
প্রশ্ন- বঙ্গ রাজনীতিতে ঘরানার কি পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন?
অরুণাভ ঘোষ- কংগ্রেস রাজনীতি বলে তো শুরু করিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজে নকশালরা প্রবল প্রতাপশালী ছিল। আমরা তখন সবে কলেজে ঢুকেছি। ঢুকে দেখলাম নকশালরা যত না পড়াশুনায় জোর দেয় তার থেকে বেশি গাজোয়ারী করছে। মানা যায় না। আমি পাড়ার ছেলে, উত্তর কলকাতার ছেলে। রিভোল্ট করলাম। ফাটাকেস্টকে এনে ছাত্র পরিষদ ওপেন করলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তা নাহলে সুব্রতকেই মেরে দেবে। কিন্তু তখন এই রাজনীতিটি ছিল না। কংগ্রেস, সিপিএম, নকশালের ব্যাপার না, একজন লেফট আরেক জন অ্যান্টি লেফট।
প্রশ্ন- কথা বলার ধরণ বদলেছে রাজনীতিতে, পার্থক্য কিছু দেখছেন?
অরুণাভ ঘোষ- তুলনাই চলে না। তখন ইকোনোমিকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া লোক রাজনীতি করেছে। ফিজিক্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট রাজনীতি করেছেন, নকশালদের দেখেছি। এখন এইসব নেই। আমি ওই সেন্স-এ বলছি না। রাজনৈতিক পড়াশুনাটাই নেই। যেমন কাস্ত্রো সম্পর্কে কেউ জানে না।
কোয়ালিটি ভয়ঙ্কর নেমে যাচ্ছে। শুভেন্দুকে দেখলে সকাল-বিকেল মেজাজ গরম হয়ে যায়। কি বলছে কি না বলছে। বিরোধীদল নেতা জ্যোতি বসুকে দেখেছি। সিদ্ধার্থ বোস একমসয় বিরোধী দলনেতা ছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দেখেছি, পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছি। এ চলে না।
প্রশ্ন- শুভেন্দুর ডিসেম্বর রাজনীতি। কি বলবেন?
অরুণাভ ঘোষ- কেন্দ্রীয় এজেন্সিতে কেসের রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে, তা পাচ্ছে কি করে? কাকে চার্জশিট দেওয়া হবে না হবে, ও জানল কি করে? কেন্দ্রীয় সংস্থা তার জন্য ফেল করছে। সিবিআই ১০০টার মধ্যে ৯৭টা ফেল করেছে। গত পাঁচ বছরের রিপোর্ট। এরকম আগে থেকে বলে দিলে তো হবেই।
প্রশ্ন- শিক্ষাসংক্রান্ত দুর্নীতির রায়ে বিচারপতির ধ্যানধারনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন। কেন?
অরুণাভ ঘোষ- প্রথমত খুনের আসামীকে ফাঁসির মঞ্চে তুলতে গেলেও আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেওয়া উচিত। সেটা এই জজসাহেব বাতিল করলেন তখন এরা কেউ জানতেই পারল না। আমরা যা বলেছি অলমেটলি সুপ্রিম কোর্ট মানল। তবে এই বিচারপতি কিন্তু বেসিক্যালি অনেস্ট। সুবিচার ও আইনের পথে চলা এই পার্থক্যটা বোঝা দরকার। সুবিচার তো মুখে মুখে করে দেওয়া যায়। কিন্তু আইনের মাধ্যমে গেলে একটু রয়েসয়ে করতে হয়। সেটা করেনি বলেই আমি ক্রিটিসাইজ করেছি। তা নাহলে তিনি অনেস্ট ম্যান। সৎ মানুষ।
প্রশ্ন- দুর্নীতির তদন্ত কতদূর পৌঁছাবে?
অরুণাভ ঘোষ- ৯৫ সলে স্কুলের নিয়োগে সিলেক্ট কমিটির ভূমিকা থাকত। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে নাম চেয়ে পাঠাল। নিজেও আবেদন করতে পারত। সেখানে সিলেক্ট করত সিলেক্ট কমিটি। সেখানে যে যার নিজের লোক ঢুকেয়েছে সেটাও তো দুর্নীতি।
প্রশ্ন- বাম-কংগ্রেস জোট করে লড়াই করেছে। জোটের ভবিষ্যৎ কি?
অরুণাভ ঘোষ- সময়ই বলবে। সময়ই পরস্পর বিরোধী শক্তিকে কাছাকাছি এনে দেয়। যেমন অটলবিহারী বাজপেয়ী জ্যোতি বোস এক জায়গায় এসেছিলেন। সিপিএম, কংগ্রেস কাছাকাছি এসেছে তৃণমূলকে আটকানোর টানে। সেই জন্য এসেছে। সময় কাছে এনেছে। সময় হিটলার ও স্ট্যালিনকে কাছে এনেছিল আবার দূরে সরিয়ে নিয়েছে।
প্রশ্ন- কংগ্রেসের সাংগঠনিক অবস্থা কি মজবুত হতে পারে?
অরুণাভ ঘোষ- কেন্দ্রে শক্তি না হলে আসে না। কেন্দ্রে যদি কংগ্রেস আসে তা হলে এখানেও শক্ত হবে। তবে এখনও ৪৬ বছর ক্ষমতায় নেই তবুও কংগ্রেসের লোক পাওয়া যায়। এটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। অন্য দলে হত না।
প্রশ্ন- ২০২১ বিধানসভা ভোটে কি খেলা ছিল? আপনার ধারনা কি?
অরুনাভ ঘোষ- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা আমিও করি। কিন্তু ওর যা মাটির জ্ঞান তা কারও নেই। ওর মাটির সঙ্গে সম্পর্ক তাতেই জিতেছে। সংগঠনে জিতেছে। কোনও কারণ ছাড়া মমতা সম্পর্কে গালাগাল করছে। তুমি তার মডেলটাকে গালাগাল করছো, কিন্তু প্যারালাল মডেলটাও তো বলতে হবে। এটা আমার মডেল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চোর বলছে কিন্তু প্রমানটা কোথায়? এলাকায় নজর রাখলেই কাউন্সিলরদের চুরি দেখা যাবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চোর বললে কিছু প্রমান তো দিতে হবে। সবাই জানে, তা বললে তো হবে না। সারা দিন রাজনীতি করছে। রিচটা খুব বেশি। নীচু লেভেল থেকে ওঠা তো এঁদের অ্যাম্বিশনটা ভয়ানক উঁচু হয়। এরা যে সময়টা দেয় তা অন্যরা দিতে পারবে না। বুদ্ধবাবু ভাল লোক পড়াশুনা করেন কিন্তু এই লেভেলে করতে পারবেন না। আমি ভয়ানকভাবে মমতার বিরোধী কিন্তু মাটির গন্ধ ওর মতো কেউ বোঝে না।
প্রশ্ন- মমতা বা তৃণমূলের কোনও বিকল্প?
অরুণাভ ঘোষ- আপাতত নেই। তবে সিপিএমের পড়াশুনা জানা লোক আছে, কংগ্রেসের তো আছেই। অসুবিধা হচ্ছে কংগ্রেস বা তৃণমূলের পাঁচটা লোক হলে সবাই চেনে তাঁরা ভাল-মন্দ যাই হোক, বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেও। কিন্তু সিপিএমের লোকেরা মিটিং-এ যাচ্ছে, ভাল ভাল লোক আছে তাঁরা সামনে আসছে না। মিনাক্ষীর- মধ্যে মমতার ধাঁচ আছে। যা পারছে বলে যাচ্ছে। মেয়েটার জোশ আছে। ওই লেভেলটা নেই। ৭০-দশকে সব দলের লোকেদের পড়াশুনা ছিল।
প্রশ্ন- তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়লেন কেন?
অরুণাভ ঘোষ- তৃণমূলটা ছেড়েছি দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। মমতাকে বলেছিলাম ও কিছু করল না। তাই ছেড়ে দিলাম। মমতার সঙ্গে ব্যক্তিগত লড়াই ছিল না। পলিটিক্যালি যার পয়সা আছে তুমি যত বড় নেতা হও না কেন তাঁকে সমর্থন করতে হবে। জ্যোতি বসু সুভাষবাবুকে সমর্থন করতেন, ক্ষমতা ও পয়সা দুই সুভাষবাবুর ছিল। মমতারও তাই ব্যাপার।
প্রশ্ন- ২৪ -এ নরেন্দ্র মোদির কি হবে?
অরুণাভ ঘোষ- আমি জানি না। দেশের সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নন ম্যাট্রিক ভাবা যায় না। এই ধরনের লোক ২ কোটি লোককে বছরে চাকরি দেবে সেখানে ৭ লক্ষ ৭৩ হাজার চাকরি পেয়েছে ৮ বছরে। মিথ্যা কথা বলার লিমিট আছে। আমি তো রাস্তায় গিয়ে বলতে পারব না। মোদি বলে দেবে। ওর মতো মিথ্যাবাদী প্রধানমন্ত্রী ভারতবর্ষে জন্মায়নি।
প্রশ্ন- হিমাচলে কংগ্রেসের জয় কাজে আসবে?
অরুণাভ ঘোষ- সেটা জানি না কাজে আসতে পারে তবে কংগ্রেস যে লোকে করছে এটাই বিরাট ব্যাপার। কংগ্রেস তো ক্ষমতায় নেই। ক্ষমতায় না থাকলে কটা লোক পার্টিটা করে সেটা তো সিপিএমকে দেখেই বুঝছি। ক্ষমতায় যখন ছিল একরূপ এখন কোথায় সিপিএম।
প্রশ্ন- রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রায় কি সংগঠন মজবুত হবে?
অরুণাভ ঘোষ- সংগঠন মজবুত তো হচ্ছেই। পরস্পরের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। দেখা-সাক্ষাৎ হয় না, হচ্ছে। রাহুল গান্ধীকে পাপ্পু বলত, কিন্তু ওর মতো পড়াশুনাটা কটা লোকের আছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা। কেমব্রিজে পড়াশুনা করেছে। ওর মতো কজন লোক বক্তৃতা দেয়। কজন লোক ফেস করতে পারে সাংবাদিকদের।
প্রশ্ন- কংগ্রেসের এই পরিস্থিতি কেন?
অরুণাভ ঘোষ- মানুষের ওপর নির্ভর করছে। মানুষ ভোট দিচ্ছে না।
প্রশ্ন- দেশ বা রাজ্যে দুই ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর সমালচোনা চললেও ভোট বাক্সে তার কোনও প্রভাব নেই?
অরুণাভ ঘোষ- লোকে প্যাশনে ভোট দিচ্ছে। বিজেপিকে মারতে পারবে তৃণমূল, তৃণমূলকে মারতে পারবে বিজেপি, এই আর কি।
প্রশ্ন- পঞ্চায়েত নির্বাচনে কি হবে?
অরুণাভ ঘোষ- পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল জিতবে। রক্তক্ষয় তো হবে না হাতুড়ি আর ছুড়ি দেখিয়ে ভোট হবে। ছাপ্পাভোট হবে। রক্তক্ষয় মানে বিরোধীদের তো থাকতে হবে তারা তো নেই। সুপ্রিম কোর্টও দায়ী এর জন্য়। ৩৫ শতাংশ ভোটে ক্য়ান্ডিডেট দিতে পারেনি। অনুব্রতের বীরভূমে তো প্রার্থীই দেওয়া যায়নি। সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলাম। সুপ্রিম কোর্ট বলল কমশিনের কাছে যাও। মনোনয়ন জমা দিতে পারলাম না, ওখানে গিয়ে অভিযোগ করব? পরে দেখা গেল ত্রিপুরায় ৯২ শতাংশ আসনে বিজেপি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বীতায় জয় পেল।
প্রশ্ন- রাজ্যে বোমা-গুলি চলছে?
অরুণাভ ঘোষ- একখানা বোমা পাওয়া গিয়েছে। ৭০-৭১-এ তো ঘরে ঘরে বোমা পাওয়া গিয়েছে। যাঁরা রাজনীতিতে জড়িত ছিল তাঁদের ওয়ান সাটার রিভলবার থাকতো। বলে লাভ আছে। এই তিনটে বোম পাওয়া গেল কলকাতায়, হইচই জুড়ে গেল।
প্রশ্ন- কলেজে ভোট হচ্ছে না।
অরুণাভ ঘোষ- কলেজে কলেজে ভোট হওয়া উচিত। তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন ভোট করতে দেবে না।