বাগুইআটিতে জোড়া ছাত্রের নৃশংস খুনের ঘটনায় তোলপাড় পুলিশ-প্রশাসন থেকে রাজ্য-রাজনীতি। মৃত অতনু দের দুটি বাড়ি পরেই মূল অভিযুক্ত পাড়ার 'জামাই' সত্যেন্দ্র চৌধুরীর বাস। আর এই নেতাজিপল্লীর কিশোরদের সঙ্গে মেলা-মেশা জুড়েছিল মধ্য তিরিশের সত্যেন্দ্র। স্থানীয়দের দাবি, মূলত মোবাইল গেমের নেশাই কাল হল অতনুর। ওই গেম থেকে টাকা আসত জেনেই ফাঁদ পেতেছিল সত্যেন্দ্র।
অতনুর বাড়ির সামনেই কথা হচ্ছিল ওর পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে। শোকে কাতর বন্ধুরাও ওই নেতাজিপল্লীর গলিতে কাটিয়েছে সারাটা দিন। শুভজিৎ মাইতি, সৌমাল্য মাইতি, আকাশ রাজভররা জানিয়ে দিল, তারাও মোবাইল গেমের নেশায় বিভোর। তাঁদের মধ্যে বেস্ট প্লেয়ার ছিল অতনু। অনেক বেশি রোজগার ছিল তার। সেই কারণেই সত্যেন্দ্রের পক্ষে বাইক বিক্রি করার ফাঁদ পাততে সহজ হয়েছে বলে জানাল অতনুর বন্ধুরা।
দশম শ্রেণির ছাত্র শুভজিতের বাড়ি অতনুর বাড়ির পাশেই। শুভজিত বলে, 'আমাদের এই পাড়ার বন্ধুদের একটাই নেশা মোবাইল গেম। মূলত ফ্রি ফায়ার গেম আমরা খেলে থাকি। মোবাইলে প্লে স্টোরে গিয়ে লোড করতে হয়। আগে এই গেমটা দেড় জিবি ছিল, এখন খেলার সুবিধার জন্য সেটা সাড়ে চারশো এমবি করেছে। এই গেম খেলে অর্থ রোজগারও করা যায়। আমাদের মধ্যে সব থেকে বেশি অর্থ রোজগার করত অতনু। নবমশ্রেণির, আকাশ রাজভরও জানিয়ে দেয়, এই গেম তাঁদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়।
নেতাজিপল্লীর অধিকাংশ কিশোরই ফ্রি ফায়ার গেমে আসক্ত। দশম শ্রেণীর সৌমাল্যও সেকথা স্বীকার করে বলে, 'আমরা খেলাধুলা করি না। স্কুল, পড়াশুনা আর এই মোবাইল গেম আমাদের সঙ্গী।' অতনুর এই তিন বন্ধুই জানিয়েছে, পাড়ার 'জামাই' সিনিয়র হলেও তাঁদের সঙ্গে মেলামেশা করত। নানা মিষ্টি কথা বলে পাড়ার ছোটদের মন জয় করার চেষ্টার কসুর করত না সত্যেন্দ্র। শেষমেশ নিজের টার্গেট পূরণ করতে বাইক বিক্রির ছক কষে। এক্ষেত্রে মোবাইল গেমে পাওয়া অর্থই কাল হয়ে যায় অতনুর।
শুভজিত, সৌমাল্য, আকশরা নেতাজিপল্লীর বাসিন্দাদের মতোই তাঁদের বন্ধুর খুনির ফাঁসি চাইছে। বন্ধুকে হারিয়ে তাঁরা শোকাতুর। দিন-রাত বাগুইআটির জগৎপুর নেতাজিপল্লীর গলিতে শয়ে শয়ে মানুষ। অতনুর বাবা রবি দে কাশিপুর গান ফ্যাক্টরির কর্মী। নেতা-মন্ত্রী-পুলিশ ঢুকছে মৃত ছাত্র অতনু দের বাড়িতে। পুলিশের বিরুদ্ধে নিস্ক্রিয়তার অভিযোগে ক্ষোভে ফুঁসছে এই পাড়ার বাসিন্দারা। ইতিমধ্যে বাগুইআটি থানার আইসিকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। বিকেলেই ঘটনাস্থলে গিয়েছেন সিআইডির আধিকারিকরা। কথা বলেছেন অতনুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।
এদিকে, অল্পবয়সীদের মধ্যে এই মোবাইল গেমের আসক্তিকে ICD (International Classification of Diseases)-এর ১১ তম সংস্করণে মানসিক ব্যাধি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এপ্রসঙ্গে বিশিষ্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোথেরাপিস্ট ড. ইন্দ্রানী বন্দ্যোপাধ্যায় সারেঙ্গি বলেন, ''বর্তমান প্রজন্মের যুবসমাজ ভিডিও গেমিং করে কখনও বাস্তব জীবনের স্ট্রেস এবং উদ্বেগ উপশমের জন্য। কখনও peer pressure-এর শিকার হয়। একবার তারা খেলতে শুরু করলে, গেমগুলির আকর্ষক ডিজাইন তাদের মনের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয়। গেমিং করার এবং জেতার আনন্দ মস্তিষ্কের পুরষ্কার কেন্দ্রকে চার্জ করে। এর ফলে যথেষ্ট পরিমাণে ডোপামিন নিঃসৃত হয়। অন্যান্য আসক্তির মতো, এক্ষেত্রেও সামান্য স্তরের pleasure-এর প্রয়োজন মেটাতে আরও বেশি উদ্দীপনার (গেমিং টাইম্) প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সীমিত এক্সপোজারের ক্ষেত্রে গেমিং মজাদার হতে পারে, তবে একটি বিন্দু ছাড়িয়ে গেলে এটি একটি অভিশাপের রূপ ধারন করে।''