'যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল', একটা সময় বীরভূমের রাজনীতিতে অনুব্রত মণ্ডলের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিলেন দুধকুমার মণ্ডল। ফি দিন অনুব্রতর শাঁসানি ও তারই পাল্টা 'দুধকুমার উবাচ', দিনের পর দিন তীব্র বাগযুদ্ধে জড়াতে দেখা গিয়েছে দুই নেতাকে। দুধকুমারের হাত ধরেই বীরভূমের রাজনীতিতে তড়তড় করে দাপটের সঙ্গে উঠে আসে বিজেপি। তৃণমূল ও অন্য দলের ঘর ভাঙিয়ে বীরভূমজুড়ে বিজেপির পায়ের তলার মাটি শক্ত করেন এই দুধকুমার। অনুব্রতর চোখে চোখ রেঙে পাল্টা মন্তব্যে দুধকুমারের জুড়ি মেলা ছিল ভার। এই দুধকুমারই এখন দলে পিছনের সারিতে।
অস্বস্তি যেন নিত্যসঙ্গী বঙ্গ বিজেপির। পালা করে একে একে নেতারা মুখ খুলছেন দলের বর্তমান রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। এবার সেই তালিকায় নবতম সংযোজন বীরভূমের প্রাক্তন বিজেপি সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল। ''আমার সঙ্গে কথা না বলেই জেলা থেকে ব্লক কমিটি গঠন করেছে। বিজেপির সমর্থক এবং কার্যকর্তারা যাঁরা আমাকে ভালোবাসেন তাঁরা চুপচাপ বসে যান।'' দলের অস্বস্তি তুঙ্গে তুলে ফেসবুক পোস্ট একদা বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ এই বিজেপি নেতার। তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক অনুপম হাজরা।
কোনঠাসা দুধকুমার দলের রাজ্য নেতাদের আচরণে তিতিবিরক্ত। তাঁর সঙ্গে আলোচনা না করেই জেলায় বিভিন্ন পদে অনভিজ্ঞদের হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ দুধকুমারের। তাই দল না ছাড়লেও অনুগামীদের বসে যাওয়ার বার্তা বিজেপি নেতার। ফেসবুক পোস্টে দুধকুমার মণ্ডলের সেই বার্তাই শোরগোল ফেলে দিয়েছে। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল দুধকুমার মণ্ডলের সঙ্গে। কেন তাঁর এই অভিমান, স্পষ্ট জানালেন সেকথা।
দুধকুমার মণ্ডলের কথায়, ''যা সত্যি তাই বলেছি। তাতে কোথাও ঢিল পড়লে আমার কি করার আছে। উপর থেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে দিচ্ছে। রাজ্য করছে জেলার নাম, জেলা করছে মণ্ডলের নাম। মণ্ডল নিজের মতো করে পদ দিচ্ছে। দল গণতান্ত্রিক ধারা হারিয়ে নতুন-নতুন ছেলেদের এনে বিভিন্ন পদে বসাচ্ছে। এই ধারায় দলের শ্রীবৃদ্ধি হতে পারে বলে বিশ্বাস করি না।''
অনুগামীদের তাই কি দল ছাড়তে বলছেন? উত্তরে অবশ্য সেকথা বললেন না দুধকুমার। তাঁর কথায়, ''দলের এই অগণতান্ত্রিক ধারার সঙ্গে অনেকে যুক্ত থাকবেন না। যাঁর যা মনে হবে তাই করবেন। কাউকে অন্য দলে যেতে বলছি না। আমিও বিজেপিতে ছিলাম আছি এবং থাকব। তবে দল যেভাবে চলছে সেই পথ ঠিক নয়।'' এরপরই একরাশ অভিমান ধরা পড়ল তাঁর গলায়।
আরও পড়ুন- এসএসসি নিয়োগে দুর্নীতির মূলে কি ‘রঞ্জন’-দের সঙ্গে প্রভাবশালী যোগ?
একদা বীরভূমের দাপুটে এই বিজেপি নেতা দলেই আজ কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। সেপ্রসঙ্গে দুধকুমার মণ্ডল বললেন, ''দলের রাজ্য নেতারা জেলায় এলেও আমার খোঁজও করেন না। আমিই সারা বীরভূমে বিজেপিকে তুলে ধরেছিলাম। পার্টি আমায় কোনও হেল্প করেনি। এখন তো পার্টি প্রচুর পয়সা দিচ্ছে, গাড়ি দিচ্ছে। তবে পার্টিটা আজ প্রতিদিন ৬ ইঞ্চি করে বসে যাচ্ছে। যাঁদের মণ্ডলস্তরে সংগঠন করার অভিজ্ঞতা নেই তাঁরাই এখন রাজ্যের বড়-বড় নেতা হয়ে গিয়েছেন। হঠাৎ করে এনে-এনে বসিয়ে দিচ্ছে।''
দুধকুমার মণ্ডল মনে করেন, এখন সরকারের বিরুদ্ধে পথে নামার মতো জ্বলন্ত একাধিক ইস্যু হাতে থাকলেও বঙ্গের বিজেপি কোর্ট ও রাজভবন নির্ভর হয়ে পড়েছে। বিজেপি নেতা বলেন, ''রাজ্যপাল বিজেপিকে এগনোর জন্য যা করছেন সেটা রাজ্য বিজেপিই করতে পারছে না। কখনও কোর্টে দৌড়োচ্ছে কখনও রাজ্যপালের কাছে দৌড়োচ্ছে। কেন্দ্রের মোদীকে দেখে সংগঠন চলছে। এদের ফেস ভ্যালু জিরো।''
এক সময়ে মানি মার্কেটিংয়ে যুক্ত থাকা ব্যক্তিরাই এখন বীরভূমে বিজেপির নেতা হয়ে বসে আছেন বলে তোপ দুধকুমারের। প্রাক্তন জেলা বিজেপি সভাপতির কথায়, ''মানি মার্কেটিং করে যাঁরা লোকেদের সর্বনাশ করেছে, তাঁরাই এখন জেলার পার্টির নেতা।'' দলে রাজ্য নেতারাও ওপর থেকে পদ পেয়ে বসে আছেন বলে কটাক্ষ দুধকুমারের। তিনি বলেন, ''ওপর থেকে পদ পেয়ে গিয়েছে। ষোলো-আনা পড়ে পওয়া পদ পেয়েছে। পুরনো কর্মীদের বলে দিয়েছি দল পাল্টাতে হবে না, বসে যান।''
আরও পড়ুন- কাজ খুইয়ে হাঁড়ির হাল সংসারের, কিডনি বিক্রির ‘বিজ্ঞাপন’ যুবকের
এদিকে, দুধকুমারের অভিমান-ক্ষোভকে সঙ্গত বলেই মনে করেন বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক অনুপম হাজরা। এর আগে অনুপমও একাধিকবার দলের বর্তমান নেতৃত্বের কাজে অসন্তোষ দেখিয়ে প্রকাশ্যে সরব হয়েছেন। এবার দুধকুমারের পাশেই দাঁড়িয়েছেন প্রাক্তন সাংসদ।
অনুপমের কথায়, ''দুধকুমার মণ্ডল বাস্তব কথাই বলেছেন তো। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি শব্দটার সঙ্গেও কেউ অত পরিচিত ছিলেন না। দুধকুমার মণ্ডলই বাংলার মানুষকে বিজেপি শব্দের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন। সাংগঠনিকভাবে বলিষ্ঠ একজন নেতা। বীরভূমে বিজেপিকে সংঘবদ্ধ করেছিলেন তিনি। সেই মানুষ যখন এমন কথা বলছেন, তখন তাঁর পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দিক বর্তমানে সংগঠনে থাকা নেতারা।'' রাজ্য বিজেপি দুধকুমারের ক্ষোভকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত অধিকারী জানিয়ে দিয়েছেন দলের নীতি অনুযায়ী দুধকুমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।