স্কুল খুলেছে। চালু হয়েছে পুলকার। তবু দুঃস্বপ্ন এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে। লকডাউনে কেউ চপ বিক্রি করেছেন, কেউ ভ্য়ানে ফল বিক্রি করেছেন, কেউ মুরগি বিক্রি করেছেন, কেউ আবার সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিও করেছেন। পেশা, বদলের পর বদল করেছেন। অনেকে এখনও পুরনো ব্যবসায় ফিরতে পারেননি। গাড়িও বিক্রি করে দিয়েছেন অনেকে। অর্থের অভাবে ট্যাক্সসহ গাড়ির নানা নথি এখনও আপডেট করতে পারেননি। কেউ কেউ ফের পুলকার ব্যবসায় নেমেছেন। পুলকার সংগঠনের দাবি, সরকার তাঁদের ব্যবসার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ালে হাজার হাজার পরিবার রক্ষা পেত।
করোনা বহু মানুষের জীবীকা পরিবর্তন করিয়েছে। বহু মানুষ কর্ম হারিয়েছে। জীবনযুদ্ধে নতুন ভাবে বেঁচে থাকার লড়াই শিখেছে মানুষ। পুলকারের সঙ্গে যুক্তদের ব্যবসাও পুরো লাঠে উঠেছিল। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর রাজ্যে স্কুল খুলেছে। তবে এখনও সেভাবে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না পুলকার ব্যবসায়ীরা।
২০০০ সাল থেকে পুলকার ব্যবসায় যুক্ত নব্যেন্দু মাইতি। মা, স্ত্রী ও কলেজ পড়ুয়া ছেলে রয়েছে সংসারে। একটি পুলকারই ছিল তাঁর জীবনজীবীকার ভরসার জায়গা। এটাতেই সংসার চলতো। মার্চ মাসে স্কুলগুলিতে পরীক্ষা চলছে। এপ্রিলে পুরোমাত্রায় খোলার কথা রয়েছে। কিন্তু এখনও তাঁর পুলকারটিকে রাস্তায় নামানোর অবস্থায় আনতে পারেননি বছর পঞ্চান্নোর নব্যেন্দু মাইতি। কালিকাপুরে ক্যালকাটা পাবলিক স্কুলের কাছে থাকেন নব্যেন্দুবাবু। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে নব্যেন্দুবাবু বলেন, 'সে এক অসহনীয় পরিস্থিতি। প্রথম দিকে কী করব ভেবে উঠতে পারিনি। সবাই বলল তেলেভাজার দোকান করতে। কালিকাপুরেই চপের দোকান করেছিলাম। সেটাও চলল না। পুরো ক্ষতি হল। আর্থিক অনটনের দরুন ছেলের প্রাইভেট টিউশন বন্ধ রয়েছে। অন্যের গাড়ি চালিয়ে কোনওরকমে পেট চালানোর ব্যবস্থা হয়েছে।' গাড়ির হাল কেমন? 'গাড়ি পুরো বসে গিয়েছে। গাড়ির নথি সব ফেল। সরকার যদি সাহায্য করে তাহলে পুল চালু করতে পারব। আমরা এখনও জানি না সরকার সাহায্য করবে কীনা।' তাঁর কথায়, 'এপ্রিল থেকে পুরোপুরি স্কুল খুলবে, তাই একটু আশা দেখছি। তখন আবার পুলকার চালাব। এখন একদুজন নিয়ে চালিয়ে কিছু হবে না।'
বাহান্ন বছরের হাসিম সর্দার। বাড়ি বাঁশদ্রোণী থানার ব্রহ্মপুর। হাসিম সর্দারের রয়েছে দুটি পুলকার। কবে স্কুল খুলবে সেই আশায় ধার-দেনা করে গাড়ি ফিট রেখেছেন। তবে অর্থের অভাবে এখনও একটি গাড়ির ট্যাক্স, ইনসিওরেন্স দিতে পারেননি। সরকার তাঁদের দিকে না তাকানোয় অনুযোগ রয়েছে হাসিমবাবুর। তাঁর বক্তব্য, 'সরকার লক্ষ্মীভান্ডার করেছে। কিছু অর্থিক অনুদান আমাদেরও দিতে পারত রাজ্য সরকার। দুটো গাড়ি ফিট করতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। একটা ট্যাক্স নথি আপডেট আছে। আরেকটা করতে পারিনি। আমাদের কোনকিছু দেখেনি সরকার। ধার-দেনা করতে হয়েছে।'
লকডাউনে পুলকার মালিকদের কেউ মুরগি বিক্রি করেছেন তো কেউ সবজি-ফল বিক্রি করেছেন। হাসিম সর্দার একটা ভ্যান কিনেছিলেন ফল বিক্রি করার জন্য। তিনি বলেন, 'লকডাউনের প্রথম কয়েকটা মাস অভিভাবকরা টাকা দিত, পরে ধীরে ধীরে তা বন্ধ করে দেয়। তারপর একটা ভ্যান নিয়ে ফল বিক্রি করছিলাম। পরিস্থিত খুব খারাপ ছিল। রস্তায় নামতে হবে। অভ্যাস ছিল না। ভাল লাভ করতে পারতাম না। জিনিস থাকলে ভয় পেতাম। দামে দামে ফল বিক্রি করে দিতাম। প্রায় এক বছর ফল বিক্রি করেছি।' হাসিম সর্দারে আশা, 'আবার স্কুল শুরু হয়েছে। অলটারনেট ডে -তে পুলকার চলছে। তিন-চারজন ছাত্র-ছাত্রী থাকছে। আগের মতো হচ্ছে না। এপ্রিল থেকে পুরো স্কুল খোলার সম্ভাবনা আছে।'
করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউন বহু পেশায় সর্বনাশ ডেকে অনেছে। এরইমধ্যে রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে। লক্ষ্মীরভান্ডারসহ একাধিক সামাজিক প্রকল্পে উপভোক্তার হাতে সরাসরি টাকা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার। সাধারণ বাসপরিবহণের ক্ষেত্রে কিছু সামান্য ট্যাক্স ছাড়ও দিয়েছিল রাজ্য। পুলকার মালিকরাও মনে করছেন, রাজ্য সরকার পাশে থাকলে এখনও কয়েকহাজার পরিবার বেঁচে যাবে। বেঙ্গল কারপুল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, 'আগামি এপ্রিল থেকে পুরোপুরি ভাবে পুলকার চলা শুরু করবে। কলকাতা ও দুই ২৪ পরগনা মিলিয়ে পাঁচ সাড়ে পাঁচ হাজার পুলকার রয়েছে। লকডাউনে অর্ধেক মানুষ গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। কেউ সবজি বিক্রি করেছে, কেউ ফল বিক্রি করেছে। গাড়ির সংখ্যা অর্ধেক দাঁড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে আবার ৫০ শতাংশ গাড়ির হাল খারাপ। নথিও আপডেট করতে হবে। সংসার চালাতে পারছে না। গাড়ি আপডেট করবে কী করে? আমাদের কোনও সুবিধা দেয়নি রাজ্য সরকার। পরিবহণমন্ত্রীকে পুরো বিষয়টা জানাবো।'