Advertisment

হিমালয়ের তুষাররাজ্যে কেন এই বিপর্যয়, কেন মৃত্যু মিছিল?

২৯ মে, ১৯৫৩। আজকের দিনেই বিশ্বের সর্বোচ্চ বিন্দুতে পা রেখেছিলেন হিলারি এবং নোরগে। এ বছর বাংলায় এভারেস্ট দিবস উদযাপনের আবহের বদলে রয়েছে স্বজন হারানোর হাহাকার। যন্ত্রণা বুকে নিয়েই কলম ধরলেন বাংলার পর্বতারোহী শ্রী দেবাশিস বিশ্বাস।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ছবি সৌজন্য- শ্রী দেবাশিস বিশ্বাস

এই লেখা কারো ভুল ধরার উদ্দেশ্যে নয়, বরং এটাকে আত্মসমালোচনা ভাবলেই প্রকৃত হবে, তাহলে হয়তো পর্বতারোহীদের এই  মৃত্যুর মিছিল ভবিষ্যতে এড়ানোর কোনো রাস্তা বের হতে পারে। পর্বতারোহণে রিস্ক আছে, তা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই,  কিন্তু তা বলে অকারণ মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।  একটা মৃত্যু মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যে শূন্যতা নিয়ে আসে তা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়।

Advertisment

এবার ইতিমধ্যেই নেপালের বিভিন্ন ৮০০০ মিটার শ্রেণীর ১৯ জনের মৃত্যু সংবাদ আমরা পেয়েছি। Allan Arnette লিখেছেন, "Sadly all of these incident suggests a level of inexperience and inadequate support"।

বক্তব্য পরিষ্কার, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের দোষে এই মৃত্যুমিছিল।

আর একজন Adrian Ballinger  বলেছেন "many clients were not receiving sufficient support or training to take on the highest mountain". পর্বতারোহণ নিয়ে নেপাল সরকারের কোনও নির্দিষ্ট বিধি নিষেধ নেই বলে Adrian বলেছেন, "Because of the lack of govt regulations specially on the Nepal side we are going to continue to see this type of accidents". তাই আমাদের মনে হয় নেপালের হাটহাজারি পর্বতারোহণ নিয়ে আরও একটু বেশি ভাবনা চিন্তার সময় হয়েছে।

সকাল দশটা সাড়ে দশটায় মিংমার ফোন- "ওদের বডি এসে গেছে। টিচিং হাসপাতলে আছে তুমি ওখানে চলে যাও"। মিংমা অর্থাৎ কাঠমান্ডুর সেভেন সামিট ট্রেকের কর্ণধার মিংমা শেরপা, প্রথম নেপালি যে ১৪ টা ৮ হাজার মিটার এর বেশি শৃঙ্গ জয় করতে পেরেছেন।  ছুটে গেলাম ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতালে, সাথে মলয়, অনন্ত দা, রমেশ,রুদ্র ও কুন্তলের আত্মীয় শ্রীরূপ। কিছুক্ষণ আগেই যেখানে পৌঁছেছে কুন্তল আর বিপ্লবের মৃতদেহ।

publive-image কুম্ভু আইসফল। ছবি- দেবাশিস বিশ্বাস

সোজা পৌঁছলাম হাসপাতালের মর্গে। নাকে মাস্ক পড়ে দুজন দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখেই তাদের একজন মাস্ক খুলে ছুটে এলো, দেখি উমেশ জিপ্রে। মুখে মাস্ক থাকায় চিনতে পারিনি।  পুনার পর্বত আরোহণ দল ;গিরিপ্রেমী'-র লিডার।

আমর পূর্ব পরিচিত। দৌড়ে এসে আমার হাত ধরে ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো, বলল, "ইন লোগোকো রোকো"। এইসে সুইসাইড করনেকে লিয়ে আনে মত দো"।

তারপর বলতে শুরু করল  এ বছরের কাঞ্চনজঙ্ঘা বাংলার দলটাকে নিয়ে ওর ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ। বহু সময় কথা হলো, তাঁর বক্তব্যের সারাংশ, এরা কাঞ্চনজঙ্ঘার দুর্গমতা, প্রতিকূলতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না নিয়ে অভিযানে চলে গেছে। তার উপর ছিল না কাঞ্চনজঙ্ঘার মত দুর্গম শৃঙ্গ অভিযানের  শারীরিক প্রস্তুতি।

আরও পড়ুন, ‘মিরাকল’ হল না, মাকালু অভিযানে নিখোঁজ দীপঙ্করের দেহ উদ্ধার

ওর কথার গুরুত্ব না দেওয়ার মত লোক উমেশ নয়। গিরিপ্রেমীর এভারেস্ট, মাকালু অভিযানে প্রস্তুতির খবর তো আমি জানি।  ওরা এক বছর আগে অভিযানের দল তৈরি করে। আলাদা জায়গায় রেখে গুরুকুলের মতো শিবির বানিয়ে প্রস্তুতি নেয়। থাকা-খাওয়া ট্রেনিং সব ওখানেই। শারীরিক এবং মানসিকভাবে চরম ফিট অবস্থায় ওরা অভিযানে অংশগ্রহণ করে। তাই ওদের সাকসেস রেট এত ঈর্ষণীয়।

তার কথানুযায়ী "তোমাদের ৫ জনেরই কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে সেই যোগ্যতা ছিল না। কুন্তল আর বিপ্লব ফিরে আসতে পারেনি, আর কপাল জোরে রমেশ আর রুদ্র সুস্থভাবে ফিরে এসেছে"। জিজ্ঞাসা করলাম "শাহাবুদ্দিন তো ফিট ছিল", বলল "হ্যাঁ ও ফিট  ছিল কিন্তু টিম মেম্বার হিসেবে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। সারাক্ষণ টিমের বাকি চারজনের সাথে ঝগড়া করে গেছে"।

লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। আমি বলেই হয়তো উমেশ ওঁর ভেতরের দুঃখ কষ্ট জ্বালা ব্যথা পুরোটা উগরে দিল, তারপর বললো এবার কাঞ্চনজঙ্ঘায় মোট ৬৮ জন আরোহণ করেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা ইতিহাসে এটা কোনদিন হয়নি।  কারো কোনও  সমস্যা হল না, শুধু বাংলার দলটা এত বড় বিপদে পড়লো কেন?

আরও পড়ুন, জনাকীর্ণ এভারেস্ট, শৃঙ্গ ছোঁয়ার স্বপ্ন আগলেই সমতলের পথে পিয়ালি

৬৮ জন! অথচ ১৯৫৫ সালে প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণের পর ২০১১ সালে যখন আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করি, সেই ৫৫ বছরেরও বেশি সময়ে মোট আরোহীর সংখ্যা ১৫০-এর কম ছিল বলে জানি, সেখানে শুধু এবছর ৬৮ জন অভিযাত্রী!  সামিটের দিন আবহাওয়াও খুব খারাপ ছিল বলে শুনিনি তা সত্বেও এত বড় দুর্ঘটনা, তাহলে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? আমরা যদি বাস্তবিকই সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করি তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে এরকম কোন দুর্ঘটনা এড়াতে পারি। সমস্ত খেলাতেই স্ক্রিনিং বলে একটা মাপকাঠি থাকে। যেমন দৌড়ে একটা সময়, হাই-জাম্প, লং-জাম্প, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস সব খেলা তে কোনও না কোনও মাপকাঠি বেধে দেওয়া হয়। সেটা টপকাতে পারলে তবেই প্রতিযোগিতার যোগ্যতা অর্জন করা যেতে পারে।

সেখানে পর্বতারোহণের সেরকম কিছু নেই। ভারতবর্ষে পর্বতারোহণ করতে গেলে তাও ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশন এর কিছু কাগজপত্র দেখে তবে পারমিশন দেওয়া হয়। কিন্তু নেপালে সে সবের বালায় নেই। পারমিট ফিজ জমা দিলে সেখানে যেকোনো শৃঙ্গ অভিযানের পারমিশন পাওয়া যায়। কাঠমান্ডুতে অসংখ্য এজেন্সি রয়েছে যাদের হাতে টাকা দিয়ে দিলে কাগজপত্রের সব কাজটুকু তারাই সারে।

ফলে  যে আরোহণ করতে যাচ্ছে, তার আরোহণের ক্ষমতা যাচাই করার কোনও প্রথা  কিংবা দায় কোনও দায়িত্ব কারোর নেই। যদি কারোর থেকে থাকে সেটা শুধুমাত্র আরোহীর।  আরোহী যদি নিজেই নিজের যোগ্যতা যাচাই না করে অভিযানে যাবার হঠকারিতা করে তবে দুর্ঘটনা হবার প্রবল আশঙ্কা থেকে যায়।

আরও পড়ুন, কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে নিখোঁজ বিপ্লব-কুন্তলের দেহ উদ্ধার করল ছয় শেরপার দল

পাহাড়ে যত দুর্ঘটনা হয়েছে তার বেশির ভাগটাই দেখেছি আরোহীর নিজের ভুলে হয়েছে।  কিন্তু আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাস্তব পরিবেশকে পর্যালোচনা না করেই কোনও ঘটনা বিশ্লেষণ করতে হিরো কিংবা ভিলেন খুঁজতে বসে যাই।

কেউ আরোহণ করে ফিরে এসেছে, তৎক্ষণাৎ তাঁকে হিরো বানিয়ে স্তুতি করতে লেগে যাই, কোনও দুর্ঘটনার খবর এলেই হয় শেরপা নয় বাজে আবহাওয়া, নয়তো কোন অক্সিজেন বিভ্রাট বা এজেন্সির গাফিলতি- কোনও একটা ভিলেন হাতের কাছে আমাদের চাই ই চাই।  এবার যেমন শোনা যাচ্ছে রিফিল অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করার জন্যই ওদের অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই এত দুর্ঘটনা। আমি ২০১০ সাল থেকে ৮০০০ মিটার এ যাচ্ছি। আজ অব্দি কোন বছর ছেদ পড়েনি। প্রতিবছর দেখেছি সবাই ওই রিফিল সিলিন্ডারই ব্যবহার করে। এ বছরও কাঞ্চনজঙ্ঘায় বাকি ৬৪ জন ওই রিফিল সিলিন্ডারই ব্যবহার করেছিল। তবে তাদের একই বিপদ কেন হল না?

যতদূর শুনেছি এদের ৪ নম্বর ক্যাম্পে নামতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল।  স্বাভাবিক নিয়মেই সিলিন্ডারে অক্সিজেন ফুরিয়েছে যাতায়াতের সময়টাকে তো হিসেবে রাখতে হবে। বলা হচ্ছে শেরপারা ছেড়ে চলে গেছে। আমি শেরপাদের ক্লিনচিট দিচ্ছিনা,  কিন্তু কোন আরোহী যদি তার মাস্ক ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে শেরপা কে বলে আমি কোথাও যাবো না তবে সেই ডেথ জোনে শেরপা বাচারাই বা কী করবে? তাঁকে তো বেঁচে ফিরতে হবে, সেও তো মানুষ।

এজেন্সি মারফত যে খবর জানা যায় তার সারার্থ, বিপ্লব কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করে ফেরার সময় শুরু হয় সমস্যা। শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তাঁর। পর্বত  আরোহণের ভাষায় যা হাই অল্টিটিউড পালমোনারি ইডিমা নামে পরিচিত।  ৮  হাজার মিটারের বেশি  উচ্চতাই আসলে ডেথ জোন।  বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ অনেক কম, ফলে বেশিক্ষণ অত উঁচুতে থাকলে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যেতে বাধ্য। শরীর প্রয়োজনীয় অক্সিজেন না পাওয়ার জন্য এই পরিস্থিতিতে ফুসফুসে জল জমতে থাকে, ফলে শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ আরো কমে গিয়ে চলাফেরার ক্ষমতা ক্রমশ কমতে থাকে। তখন সে ঘুমিয়ে পড়তে চায়। তার কেবলই মনে হয় একটু বিশ্রাম নিলে কিছুক্ষণ ঘুমালে শরীর চাঙ্গা হয়ে যাবে। কিন্তু সে বুঝতেও পারেনা সেই ঘুমই তার শেষ ঘুম হবে। সেই ঘুম আর কোনদিন ভাঙবে না। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র উপায় তাকে দ্রুত নিচে নামানোর।

কিন্তু ৮০০০ মিটার এক অন্য জগত। যেখানে প্রতিটা পদক্ষেপ ভয়ঙ্কর কষ্টের সেখানে অন্য এক মরণাপন্ন যাত্রী কে সঙ্গে নিয়ে নামানো অসম্ভব এক কাজ। খেয়াল রাখতে হবে যে নামানোর চেষ্টা করছে সেও আরেকজন অভিযাত্রী, সেও একইরকম ক্লান্ত।
এবছর শুধু বাঙালি দেরই পাহাড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা হয়েছে তা কিন্তু নয়। এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী নেপালের ৮০০০ মিটার এ বছর বসন্তের মোট ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে অন্নপূর্ণা, লোৎসে ও চো ইউ তে একজন করে, মাকালুতে ৪ জন, ও কাঞ্চনজঙ্ঘায় তিনজন আর এভারেস্টে ৯'জনের মারা যাওয়ার খবর এসেছে।

publive-image

আমি এ বছর চো ইউ'তে ছিলাম; তিব্বতের দিক থেকে। সেই অভিযানে এক শেরপার মৃত্যু হয়। এখানেও মৃত্যুর কারণ  তার নিজের ভুল।

প্রচন্ড হাওয়ার দাপটে এক নম্বর ক্যাম্পের উপর সমস্ত রাস্তায় ওপরের হালকা বরফ উড়ে গিয়ে নিচের হার্ড ব্লু আইস বেরিয়ে পড়েছিল। ব্লু আইস ভয়ঙ্কর পেছিল এবং বিপদজনক। দড়ির সাহায্য না নিয়ে সেই পথে এগোচ্ছিল এসব ক্ষেত্রে সাধারণত নিচের  শেরপারা দড়ি দিয়ে বিলে করে। কিন্তু ও কারো কথায় কান না দিয়ে দড়ি ছাড়া উঠতে থাকে, হঠাৎ পিছলে নীচের খাদে পড়ে। সাথে সাথে মৃত্যু হয় ওর। এখানে কি তার মৃত্যুর দায় ব্লু আইসের নাকি এই হঠকারিতার? এই দুর্ঘটনার সাথে সাথে ১৫ জনের দল অভিযান বাতিল করে। আরোহণ করার জন্য মূলত আমরা অবশিষ্ট পড়ে থাকি তিন জন আরোহী এবং তিন জন শেরপা।

নিজের সীমাবদ্ধতা ও পাহাড়ের দুর্গমতাকে ঠিকঠাক বোঝার অভাবে অতীতে আমরা হারিয়েছি ছন্দা গায়েনকে। এবছরও পিয়ালী বসাক এর মধ্যে দেখেছি একই হঠকারিতা। এর আগে বলার মতো অভিযান মানাসলু। শুধু সেইটুকু অভিজ্ঞতা সম্বল করেই গিয়েছিল এভারেস্ট আর লোতসে আরোহণে, তাও অক্সিজেন ছাড়া। এটাকে দুঃসাহস তো বলবই না, এটা হঠকারিতা। যেকোনও পরিস্থিতির জন্য নিজেকে ধাপে ধাপে তৈরি করাই সাধনা। আমার জানা নেই পিয়ালী কটা ৬ হাজার এবং সাত হাজার মিটার শৃঙ্গ আরোহণ করে তবে ৮ হাজারের চড়ার পরিকল্পনা করেছিল।

শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী পিয়ালি অভিযান বাতিল করে ফিরে আসছে ও যেকোনো বড় দুর্ঘটনার মুখে পড়েনি এটা ওর কপাল। আশা করব ও শুভবুদ্ধি হবে নিজেকে যদি পর্বতারোহী হিসেবে প্রমাণ করতে চায় তবে নিশ্চয়ই কিছু ছয়-সাত হাজার মিটার শৃঙ্গ চড়ে নিজের অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে তবেই ফের এভারেস্টের মতো ৮০০০ শৃঙ্গের কথা চিন্তা করবে। তাহলেই হয়তো উমেশদের আক্ষেপটা কমবে।

Advertisment