অজেয়কে জয় করার অদম্য জেদ নিয়ে মাস দেড়েক আগে ঘর ছেড়েছিলেন ওঁরা। এবার ফেরার পালা। তবে এবার আর স্বপ্ন নিয়ে নয়, স্বপ্নের কাছেই সবটুকু রেখে ঘরে ফিরবে নিথর দু'টো দেহ। কাঞ্চনজঙ্ঘার বুকেই চিরনিদ্রায় মগ্ন হয়েছেন বাংলার পর্বতারোহী কুন্তল কাঁড়ার এবং বিপ্লব বৈদ্য। নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন পর দুই পর্বতারোহীর দেহ উদ্ধার করল ছয় অভিজ্ঞ শেরপার এক উদ্ধারকারী দল।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেহ কাঞ্চনজঙ্ঘার ২ নম্বর ক্যাম্পে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। রবিবার হেলিকপ্টারে করে ২ নম্বর ক্যাম্প থেকে দেহ নেপালের রাজধানী কাথমান্ডুতে নামানোর ব্যবস্থা করা হবে। গতকাল থেকে তীব্র ঝোড়ো আবহাওয়ার মধ্যেই উদ্ধারকাজ চালানোর চেষ্টা করে গিয়েছে উদ্ধারকারী দল। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ টুইট করে এই খবর জানিয়েছেন।
Mt.Kanchenjunga Rescue Operation - The mortal remains of Biplab Baidya and Kantal Kanrar have been recovered and are being brought down to Camp 3. Thereafter, they will be brought to Camp 2 and then flown to Kathmandu by 21st - 22nd May 2019.
— Chowkidar Sushma Swaraj (@SushmaSwaraj) May 18, 2019
আরও পড়ুন: কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষে বাংলার পর্বতারোহী দল
অন্যদিকে মাকালু অভিযানে গিয়ে শৃঙ্গ ছোঁয়ার পর বৃহস্পতিবার রাত থেকে নিখোঁজ প্রখ্যাত বাঙালি পর্বতারোহী দীপঙ্কর ঘোষ। সেভেন সামিটের তরফে জানানো হয়েছে, প্রাথমিক উদ্ধারকার্য চালানোর পরেও তাঁর খোঁজ মেলেনি। আবহাওয়া প্রতিকূল থাকায় আগামি ২১ অথবা ২২ মে'র আগে উদ্ধারকার্য চালানো সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
সরকারিভাবে মৃত্যু ঘোষণার আগেই ইতিবাচক খবরের আশা একরকম ত্যাগ করেছিল বাংলার পর্বতারোহী মহল। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের এক ফেসবুক পোস্ট হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল পর্বতারোহনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িয়ে থাকা সবাইকে। বুধবার কাঞ্চনজঙ্ঘার সফল সামিট সেরে নীচে নামার সময় আশঙ্কাজনক অবস্থায় বাংলার দুই পর্বতারোহীকে পান নির্মল পুরজা। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া দুই সহযাত্রীকে নিজের অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করেন কিংবদন্তি পর্বতারোহী। পুরজা দাবি করছেন, সঠিক সময় একাধিকবার অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং সাহায্য চেয়েও পান নি তিনি। এই দুইয়ের অভাবে অকালে চলে যেতে হল দুই পাহাড় অন্ত প্রাণ মানুষকে, ফেসবুক পোস্টে এমনটাই জানিয়েছেন পুরজা।
পুরজার দাবি, এই মরসুমে প্রায় ৫০ জন কাঞ্চনজঙ্ঘা সামিট করেছেন। অথচ একটা বাড়তি সিলিন্ডার দিয়ে কেউ সাহায্য করলেন না কুন্তল এবং বিপ্লবকে। বিপ্লবের সঙ্গে তাঁর গাইড থাকলেও কুন্তলকে একাই পেয়েছিলেন পুরজা। সামিট সেরে নীচে নেমেছিলেন তিনি। শুধুমাত্র অক্সিজেনের অভাবে তাঁর চোখের সামনেই কুন্তলের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন। অক্সিজেন সঙ্কটে অতি দক্ষ মিংমা শেরপাকেও হ্যাপ (হাই অলটিটিউড পালমোনারী ইডিমা)-এ আক্রান্ত হতে দেখেন পুরজা। ততক্ষণে নিজের কাছেও আর ছিল না কোনো অক্সিজেন সাপোর্ট।
বুধবার বাংলার চার পর্বতারোহীর কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গে পা রাখার খবর এসে পৌঁছনোর পরপরই খবর আসে, অভিযানে গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের পর্বতারোহী কুন্তল কাঁড়ার (৪৬) এবং সোনারপুর আরোহী ক্লাবের বিপ্লব বৈদ্য (৪৮)। ৮,০০০ মিটারের কাছাকাছি উচ্চতায় অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই দুই পর্বতারোহী।
আরও পড়ুন, মাকালু অভিযানে গিয়ে শৃঙ্গ ছুঁয়ে নামার পথে হারিয়ে গেলেন দীপঙ্কর ঘোষ
আবহাওয়া প্রতিকূল থাকায় বুধবার রাতে এবং বৃহস্পতিবার সারাদিনে উদ্ধার কাজ চালানো সম্ভব হয়নি। তাঁদের শারীরিক অবস্থার কথা মাথায় রেখেই বৃহস্পতিবার পিক প্রোমোশন জানিয়ে দিয়েছিল, তাঁদের জীবিত থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই।
অন্যদিকে রুদ্রপ্রসাদ হালদার এবং রমেশ রায়কে শুক্রবার সকালে হেলিকপ্টারে করে কাঠমাণ্ডু নামিয়ে আনা হয়েছিল। দুজনের শরীরেই তুষারক্ষত থাকায় দিন দুয়েক স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তাঁরা। রবিবার সকালে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের। জত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতা ফেরার চেষ্টা করছেন তাঁরা। অভিযান দলের অন্য সদস্য শেখ সাহাবুদ্দিন ইতিমধ্যে কাঠমান্ডু থেকে শিলিগুড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।
বিগত তিন দিন চূড়ান্ত উৎকণ্ঠায় কেটেছে পর্বতারোহীদের পরিবার পরিজনদের। ২০১৪ সালে কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানের শেষে ছন্দা গায়েনের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং ২০১৬ সালের এভারেস্ট অভিযানে তিন পর্বতারোহীর মৃত্যুর ঘটনা কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল আশঙ্কা। সেই আশঙ্কাই সত্যি হল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঞ্চনজঙ্ঘায় আরোহণ অধিকাংশ ৮,০০০ মিটারের শৃঙ্গের তুলনায় বেশ কঠিন। স্বভাবতই সফল অভিযানের সংখ্যাও বেশ কম। ২০১৪ সালের ২০ মে কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে থেকে ফেরার পথেই নিখোঁজ হয়ে যান বাংলার পর্বতারোহী ছন্দা গায়েন। তারপর বাংলা থেকে এই প্রথম সফল অভিযান হলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্স বৃহস্পতিবার সকালেই জানিয়েছিল, এজেন্সি পিক প্রোমোশনের তরফে পাশাম শেরপা জানিয়েছেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গের ৮,০০০ মিটারের কাছাকাছি কুন্তল কাঁড়ার এবং বিপ্লব বৈদ্যর মৃত্যু হয়েছে। বিপ্লবের মৃত্যু হয় উচ্চতা জনিত শ্বাসকষ্টে। শৃঙ্গে পা রাখার আগেই কুন্তলের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছিল রয়টার্স।