Advertisment

Premium: শাঁখের করাতই জীবন, ঝুঁকি কাঁধে বারো মাস কাজ করেন শঙ্খশিল্পীরা

শাঁখের ধুলো এবং বিভিন্ন রাসায়নিক জিনিসে শরীরে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় শঙ্খ শিল্পীদের।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
Conch, conch artisans, west bengal, barrackpore, shashi ghosh, shashi ghosh story, শঙ্খ, শঙ্খবণিক, শাঁখারিপাড়া, শাঁখা, ব্যারাকপুর, শশী ঘোষ

এলাকার সব মানুষই প্রায় কমবেশি এই শঙ্খ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ

সঞ্জয় সামন্ত। বয়স আটত্রিশের আশপাশে। এক কামরার ছোট্ট ঘরে একমনে বসে শঙ্খ কেটে শাঁখা বের করছেন। উড়ে আসা শাঁখার গুঁড়োয় তাঁর শরীর-সহ দেওয়ালের চারপাশ সাদা আস্তরণ পড়ে গিয়েছে। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা শঙ্খ। মাঝে মাঝে গামছা দিয়ে মুখটা মুছে নিচ্ছেন। এই ছবিটা ব্যারাকপুরের শঙ্খবণিক কলোনি বা শাঁখারিপাড়ার। আজ থেকে অনেক বছর আগে বাংলাদেশের শাঁখারি সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে বসতি স্থাপন করেছেন। পুরনো পেশা হিসেবে বেঁচে নেন এই শঙ্খ শিল্পকেই। অন্যতম প্রাচীন হস্তশিল্প এটি। বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে শঙ্খ শিল্প বা শাঁখা শিল্প। ইতিহাস বলছে প্রায় ২,০০০ বছর আগে দক্ষিণ ভারতে শঙ্খশিল্পের উদ্ভব ঘটে। পরে বল্লাল সেনের হাত ধরে দক্ষিণ ভারত থেকে বাংলাদেশে শাঁখা শিল্পের সূচনা হয়।

Advertisment
Conch, conch artisans, west bengal, barrackpore, shashi ghosh, shashi ghosh story, শঙ্খ, শঙ্খবণিক, শাঁখারিপাড়া, শাঁখা, ব্যারাকপুর, শশী ঘোষ
শঙ্খ থেকে শাঁখা কেটে বের করছেন শিল্পী। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ

হিন্দু নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় হাতে বালার মতো শাঁখা পরেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পূজাতেও শঙ্খ দরকার। শুধু এই উপমহাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে নয়, ওলন্দাজ জাতিও শাঁখাকে পবিত্রতার প্রতীক বলে মনে করে। আর এই শাঁখের খোল কুঁদে কুঁদে কেমন করে শাঁখা বানানো যায় সঞ্জয় তা প্রথম শিখেছিলেন নিজের দাদার কাছেই। "পড়াশোনা শেষ করে দেখলাম বাজারে যা চাকরি বাকরির অবস্থা তাতে হাতের কাজ শেখাই ভালো। তারপর দাদাদের হাত ধরেই চলে এলাম এই পেশায়। শাঁখারি সম্প্রদায়ের মানুষ আমরা, এটা আমাদের রক্তে রয়েছে। বালায় নকশা তুলে মহাজনদের কাছে পাঠাই, তাঁরাই বিক্রি করে। আমি সাধারণ শাঁখাই বানাই। অনেকে আছেন যাঁরা সোনা বাঁধানো শাঁখা আর বালা বানান। সে শাঁখার ডিজাইন আবার অন্য" নিজের কাজের জায়গায় বসে বলছিলেন সঞ্জয়। গত সতেরো বছর ধরে শাঁখা বানানোর কাজ করছেন তিনি।

Conch, conch artisans, west bengal, barrackpore, shashi ghosh, shashi ghosh story, শঙ্খ, শঙ্খবণিক, শাঁখারিপাড়া, শাঁখা, ব্যারাকপুর, শশী ঘোষ
শাঁখা পালিশ করে বাছাই হচ্ছে। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ

পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ব্যারাকপুরে শঙ্খবণিক কলোনি। শাঁখারি পাড়া নামেই সকলের কাছে পরিচিত। এলাকার সব মানুষই প্রায় কমবেশি এই শঙ্খ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। অজস্র শাঁখের কাজের কর্মশালায় ভর্তি এই এলাকা। সঞ্জয়ের সঙ্গে একই ঘরে কাজ করেন আশিস সেন। তিনিও গত তিরিশ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। আশিস বলছিলেন, "লালকুঠি থেকে ঘোষপাড়া, শাঁখা উৎপাদনের কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রচুর শাঁখারি। আমি প্রথমে অন্য কাজ করতাম পড়ে এই পেশায় এসেছি। এই কাজে ঝুঁকি অনেক বেশি। যে কাজে ঝুঁকি বেশি হয় টাকা রোজগারও তত ভালো। করাত দিয়ে শঙ্খ কাটতে গিয়ে অনেক সময় আমরা নিজেরাই নিজেদের আঙ্গুল কেটে ফেলি। অথবা এই করাতও মাঝে মাঝে গরম হয়ে ফেটে যায়। আমার আঙুলে এরকম অনেক আঘাত রয়েছে।"

আরও পড়ুন তাঁতিপাড়ায় নেই মাকুরের খুটখাট, একে একে হারাচ্ছে বাংলার গামছা শিল্পীরা

Conch, conch artisans, west bengal, barrackpore, shashi ghosh, shashi ghosh story, শঙ্খ, শঙ্খবণিক, শাঁখারিপাড়া, শাঁখা, ব্যারাকপুর, শশী ঘোষ
শাঁখা কাটতে গিয়ে হাত অনেকবার কেটেছে। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ

বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, চিন, এমনকি আফ্রিকাতেও আরও এমন অনেক দেশেই এখানকার শাঁখা রফতানি হয়। চেন্নাই, কন্যাকুমারী, শ্রীলঙ্কা থেকে শঙ্খ আমদানি করে নিয়ে আসা হয় এখানে। তারপর ধাপে ধাপে কাটিং,পালিশ, ফিনিশিং,ডিজাইনের মাধ্যমে তৈরি হয় এক একটি শাঁখা। চতুর্দশ শতাব্দীতে রাজধানী ঢাকা ছিল শঙ্খ শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, মেদিনীপুরেও কম বেশি হত শাঁখা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে অনেক শাঁখারি পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসে। তারপর ধীরে ধীরে অন্ন সংস্থানের জন্যে জড়িয়ে পড়ে শাঁখা তৈরি ও ব্যবসার সঙ্গে। এভাবেই এখানে শঙ্খ শিল্পের কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করলে গড়ে দৈনিক ২৫০-৩০০ টাকা আয়। মাস শেষে মোট আয় ১০ থেকে ১৫ হাজারে সীমাবদ্ধ। যদিও আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। কারণ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কাঁচামালের দাম। আগের থেকে শঙ্খ শিল্পীদের রোজগার কিছুটা হলেও কমেছে। কুটির শিল্পী হিসেবে মেলে না কোন সরকারি সুযোগ সুবিধাও। আর আঘাত লাগা কিংবা চোট পাওয়ার সম্ভাবনা লেগেই রয়েছে।

Conch, conch artisans, west bengal, barrackpore, shashi ghosh, shashi ghosh story, শঙ্খ, শঙ্খবণিক, শাঁখারিপাড়া, শাঁখা, ব্যারাকপুর, শশী ঘোষ
শাঁখা কাটা হচ্ছে মেশিনে। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ

শঙ্খ শিল্পের প্রধান উপকরণ সমুদ্রের বিশেষ কয়েক প্রজাতির শঙ্খ, যা শ্রীলঙ্কার জাফনা ও ভারতের চেন্নাইয়ের তিতপুরে পাওয়া যায়। শ্রীলঙ্কা থেকে আসা শঙ্খের চাহিদাই সব থেকে বেশি। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে শ্রীলঙ্কা থেকে শঙ্খ আমদানি করা যাচ্ছে না। যার ফলে শাঁখা তৈরিতে ভরসা করতে হচ্ছে দক্ষিণ ভারত থেকে আসা শঙ্খের উপর। মহাজনেরা আন্দামান আর চেন্নাই থেকে শাঁখ আমদানি করে। শাঁখ আসলে একধরনের সামুদ্রিক শামুকের খোল। সেই খোলের আকার অনুযায়ী হয় সেটাকে শঙ্খ হিসেবে বাজানোর জন্য ব্যবহার করা হয়, নয়তো পাঠানো হয় তার থেকে হাতের শাঁখা তৈরির জন্য। ভারি আর মোটা শাঁখ দিয়ে বালা তৈরি করা অপেক্ষাকৃত সহজ, কারণ ছোটো বা হালকা হলে ড্রিলের আঘাতে তা ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অতএব হালকা শাঁখের খোল দিয়ে বাজানোর শঙ্খ তৈরি হয়, আর ভারি খোল লাগে শাঁখা তৈরির কাজে। বালাগুলি খোল থেকে বার করার আগে সেটিকে প্রথমে হাতুড়ি দিয়ে ভাঙা হয়, তারপর ড্রিলের সাহায্যে কাটা হয়। এরপরের কাজ শিল্পীদের, তাঁরা প্রতিটি শাঁখা ঘষে ঘষে পালিশ করেন। "কেউ শাঁখের খোল ভাঙার কাজ করে, কেউ বালা বানায়। আমরা সবাই আলাদা আলাদা মহাজনের অধীনে কাজ করি," বলছিলেন সঞ্জয়। তিনি আরও বলছিলেন, "এখন শাঁখের জোগান কমে আসার দরুণ শাঁখ ও শাঁখার বিক্রি পড়ে গেছে। আমরা চাই কাঁচামালের দাম কমানো হোক, যাতে তা আমাদের সামর্থ্যে কুলায়। কাঁচামালের কালোবাজারি নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত সরকারের"।

Conch, conch artisans, west bengal, barrackpore, shashi ghosh, shashi ghosh story, শঙ্খ, শঙ্খবণিক, শাঁখারিপাড়া, শাঁখা, ব্যারাকপুর, শশী ঘোষ
এই ধরনের ঘুপচি ঘরেই কাজ করেন শিল্পীরা। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ

অজস্র শাঁখের কর্মশালায় ভরা শঙ্খবণিক কলোনি, বেশিরভাগের আয়তন একটা ছোট ঘর বা গ্যারেজের মতো। কর্মশালায় একটিই ছোট জানলা আছে, শাঁখ কাটার সময়ে ওড়া সাদা ধুলোয় ঢাকা পড়ে সেসব। এক কোণে রাখা আছে দুইখানা শাঁখ কোঁদার মেশিন, আর ঘরের অন্য দিকটা ভর্তি এখনও প্রক্রিয়াকরণ হয়নি এমন কাঁচা শাঁখের খোল। শাঁখের ধুলো এবং বিভিন্ন রাসায়নিক জিনিসে শরীরে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় শঙ্খ শিল্পীদের। যার জন্যে নতুন প্রজন্মের অনেকেই মুখ ফিরিয়েছে এই পেশা থেকে। আর যেভাবে জিনিসের দাম বাড়ছে তাতে বাজার পড়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো শঙ্খ শিল্পীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হবে চরম অনিশ্চয়তা।

West Bengal Barrackpore Conch Conch Artisans
Advertisment