গত ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি উজাড় করে সমর্থন দিয়েছে বিজেপিকে। তৃণমূল কংগ্রেসের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের একাংশের ভোটাররা। পরবর্তীতে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনেও রাজ্যে পদ্ম শিবিরের মান রক্ষা করেছিল উত্তরবঙ্গই। তবে কিছুটা জমি ফিরে পেয়েছিল তৃণমূলও।
গত পুরসভা ও সম্প্রতি গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে একচেটিয়া জয় পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। যদিও বিজেপির দাবি, সন্ত্রাস ও ভোট লুঠের কারণেই এই ফলাফল। তৃণমূল অস্বীকার করেছে এই অভিযোগ। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ভোটারদের কাছে টানতে আগ্রহী তৃণমূল। উত্তরবঙ্গের পরিচিত মন্ত্রী বা শীর্ষ নেতৃত্বদের বাদ দিয়ে এবার ২১ জুলাই মঞ্চে বক্তব্য রেখেছেন সিতাইয়ের তৃণমূল বিধায়ক জগদীশচন্দ্র বর্মা বসুনিয়া। সদ্য রাজ্যসভায় সাংসদ হওয়া প্রকাশচিক বরাইকও শহিদ দিবসের মঞ্চে বক্তব্য রেখেছেন। একজন রাজবংশী ও আরেকজন আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধি।
রাজ্যের মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের সময়ের পর ৫ অগাষ্ট ২০২২ জগদীশ চন্দ্র বসুনিয়া তাঁর ফেসবুকে লিখেছিলেন 'আই অ্যাম ফ্রি'। কিন্তু তা কেন লিখেছিলেন, তার ব্যাখ্যা তিনি দেননি। একসময় ফরোয়ার্ড ব্লকে ছিলেন কোচবিহারের সিতাইয়ের দুবারের তৃণমূল বিধায়ক। এবার ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে ভাষণ দিয়ে স্বভাবতই উৎফুল্ল জগদীশবাবু। তাঁর কথায়, 'বিজেপি যতই রাজবংশীদের ভোট পাওয়ার চেষ্টা করুক না কেন তৃণমূলেই ভরসা তাঁদের। বরং রাজবংশীদের সঙ্গে অন্যদের সমস্যা তৈরি করতে চাইছে বিজেপি। তা সম্ভব নয়।' তিনি জানিয়ে দেন, পঞ্চায়েতের আগে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামেও তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন।
সম্প্রতি রাজ্যসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী করে গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান অনন্ত মহারাজকে। কোচবিহারকে পৃথক রাজ্যের দাবি তুলেছিলেন তিনি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী স্পষ্ট বলেছেন, উত্তরবঙ্গ বিজেপির ওপর ভরসা রেখেছে তাই উত্তরবঙ্গ থেকে বিজেপি রাজ্যসভার সাংসদ করেছে। রাজনৈতিক মহলের মতে, আগামী লোকসভা নির্বাচনে রাজবংশী ভোট অটুট রাখতেই বিজেপি এই কৌশল নিয়েছে। তৃণমূলও পাল্টা কৌশল নিয়েছে উত্তরবঙ্গে।
আরও পড়ুন- একাহিনী কখনও শোনেননি! বন্ধ অফিসে ফুঁপিয়ে কান্না! মানুষ নয়, ফোনে কে ‘ডাকল’ উপপ্রধানকে?
বিশেষত রাজবংশী অধ্যুষিত কোচবিহার জেলার রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে তৃণমূল ও বিজেপি দুই দলের কাছেই। ২০১৯ লোকসভা ভোটকে লক্ষ্য করে এই জেলা থেকেই রথযাত্রা সূচনার কর্মসূচি নিয়েছিল বিজেপি। যে বিতর্কে রাজ্য-রাজনীতি উত্তপ্ত হয়েছিল। এবার পঞ্চায়েতের আগে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই কোচবিহার থেকে নবজোয়ার জনসংযোগ যাত্রা শুরু করেছিলেন।
কোচবিহার থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, উদয়ন গুহদের মন্ত্রী করে গুরুত্ব দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এদিকে দলের সভায় বিতর্কিত মন্তব্য করতেও দেখা গিয়েছে জগদীশ বসুনিয়াকে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে বিরোধীদের পা ভাঙার নিদান দিয়ে ফের বিতর্কের জেরে নজরে আসেন বসুনিয়া। দিনহাটার বিধায়ক উদয়ন গুহ মাঝে-মধ্যেই এমন কথা বলে থাকেন। সূত্রের খবর, উদয়ন গুহর সঙ্গে বসুনিয়ার দলের অভ্যন্তরে মতবিরোধ রয়েছে। উদয়ন গুহর লাগাতার হুঙ্কার বক্তব্য নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি জগদীশবাবু। তবে রবীন্দ্রনাথ ঘোষের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক বসুনিয়ার। রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বা উদয়ন গুহরা রাজবংশী সম্প্রদায়ভুক্ত নয়।
রাজনৈতিক মহলের মতে, আগামী লোকসভা নির্বাচনে রাজবংশী ভোটে ভাগ বসাতেই জগদীশ বসুনিয়াকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। রাজবংশী নেতা অনন্ত মহারাজকে রাজ্যসভায় পাঠিয়ে লোকসভার আগে উত্তরবঙ্গে বিশেষ বার্তা দিতে চাইছে বিজেপি। সেক্ষেত্রে দলের অন্যদের বাদ দিয়ে বসুনিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। কোচবিহার সহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে রাজবংশী ভোট যে বড় ফ্যাক্টর তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন- মালদা কাণ্ডের প্রতিবাদে তুমুল বিক্ষোভ বিজেপির! SP অফিস ঘেরাও করে রাতভর অবস্থান
গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অনন্ত মহারাজের সঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ৩ দিন আগে দেখা করেছিলেন তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও তা সৌজন্য সাক্ষাৎ বলেই তাঁরা দাবি করেছিলেন। তারপর তো বিজেপি রাজ্যসভার সাংসদ করল অনন্ত মহারাজকে। রাজনৈতিক মহলের মতে, সৌজন্য সাক্ষাৎ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা হলেও অনন্ত মহারাজ পদ্মশিবিরের দিকেই পা বাড়ালেন। স্বভাবতই লোকসভার ভোটের আগে রাজবংশী ভোটারদের কাছে টানতে জগদীশ বসুনিয়ার গুরুত্ব বাড়ল তৃণমূলে।