Advertisment

মাওবাদ: 'ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গলমহল' এবং বম্বে হাইকোর্টের মন্তব্য

"ঠিক কোন বই না পড়লে, বাড়িতে বা নিজের কাছে না রাখলে নিরাপদে থাকা যাবে?” প্রবীণ সাংবাদিকের এ প্রশ্ন শ্লেষ ছিল না কি কাতরতা, সে নিয়ে সংশয় থেকেই গেল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
War and Peace, Bombay High Court

বিশ্বজিৎ রায়। ছবি: ফেসবুক

"হ্যাঁ, শঙ্কিত তো আমি বটেই। পুলিশ সিজার লিস্টে আমার বইয়ের কথা বলেছে বলে বম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি জানিয়েছেন। টলস্টয়ের বই নয়, আমার বই। 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' নয়, 'ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গলমহল'।" কথা হচ্ছিল বিশ্বজিৎ রায়ের সঙ্গে। প্রবীণ এই সাংবাদিক, বা বলা ভালো তাঁর একটি বই, হঠাৎ করেই জাতীয় সংবাদমাধ্যমের নজরে আসছে।

Advertisment

দুদিন আগেই মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে ধৃত ভার্নন গনজালভেজের বাড়ি থেকে বাজেয়াপ্ত বইয়ের তালিকার একটি বই সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি সারঙ্গ কোতোয়াল। প্রথমে জানা গিয়েছিল, তিনি প্রশ্ন তুলেছেন 'ওয়ার অ্যান্ড পিস'-এর মত অন্য দেশের যুদ্ধের বই কেন গনজালভেজের কাছে ছিল। সে নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্ক শুরু হওয়ায়, পরদিন বিচারপতির তরফ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয়, তিনি টলস্টয়ের বই সম্পর্কে অবহিত। তিনি জানিয়েছেন, যে বই নিয়ে কথা বলেছিলেন তিনি, তার নাম 'ওয়ার, পিস অ্যান্ড জঙ্গলমহল'। যে বইয়ের সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়।

আরও পড়ুন, ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ কী আমরা জানি, বলল বম্বে হাইকোর্ট

২০১২ সালে প্রকাশিত এ বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য ছিল জঙ্গলমহলে শান্তি আলোচনার ব্যর্থতার কারণ খোঁজার চেষ্টা। সে প্রসঙ্গে এসেছে নেপাল থেকে শুরু করে কলাম্বিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে সে দেশের বিদ্রোহীদের আলোচনা, সে সবের সাফল্য ও ব্যর্থতার খতিয়ানসমূহ। সম্পাদিত এ বইতে লেখা রয়েছে বালাগোপাল, ভারভারা রাও, গৌতম নওলাখা, বিনায়ক সেন থেকে শুরু করে আরও অনেকের।

War and Peace, Bombay High Court এই সেই বই

“আমি ২০১১ সাল থেকে বইটা নিয়ে কাজ করতে শুরু করি। ডেভেলপমেন্টাল পলিটিক্স বা উন্নয়নের রাজনীতি নিয়ে এই বইয়ের একটা অংশে আমি উদ্ধৃত করেছিলাম সলওয়া জুডুম মামলায় ২০১১ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায়কে। বিচরপতি বি ডি রেড্ডি ও এস এস নিজরের রায়কে। তাঁরা তাঁদের রায়ে উদ্ধৃতি দেন কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন নিয়ে জোসেফ কনরাডের 'হার্ট অফ ডার্কনেস' থেকে।”

“আমার প্রশ্ন হলো”, বলছিলেন বিশ্বজিৎ, যিনি কলকাতার সাংবাদিক মহলে মধুদা হিসেবে পরিচিত, “এই যে বইটা, সেটা তো একজন সাংবাদিকের কাজের মধ্যে পড়ে। আমি রাষ্ট্রে একটা চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেছি। সেটা আমার দায়িত্বও বটে। বিশ্লেষণী দায়িত্ব, যা সাংবাদিকের উপর বর্তায়। তার জন্য আমাকে নানারকম নথি জোগাড় করতে হয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় অর্থে বেআইনি নথি। কিন্তু আমার বইটা তো বেআইনি নয়। সেটা কোনও আন্ডারগ্রাউন্ড প্রেসে ছাপা হয়নি, প্রকাশ্যে তার বিক্রি হয়েছে, হয়। কিন্তু সে বই পুলিশ সিজার লিস্টে রেখেছে, গনজালভেজের গ্রেফতারির সময়ে। এটা শঙ্কার বিষয় বৈকি।"

"বইটার কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরেই মধুদা আমার কাছে এসেছিলেন প্রকাশনার জন্য," বললেন সুব্রত দাস। সেতু প্রকাশনার অন্যতম কর্ণধার। এই বই তাঁদেরই প্রকাশনা। ২০০৩ সাল থেকে তাঁরা বই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত। সুব্রতর ব্যবসায় তাঁর অংশীদার স্ত্রী অর্চনা দাস। সুব্রত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিকেশন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বাস্তবত, এ বিষয়ে পাঠক্রম চালু হওয়ার পর প্রথম ব্যাচের ছাত্র তিনি। অর্চনা অবশ্য ছোটবেলা থেকেই বড় হয়েছেন প্রকাশনার পরিবেশে। পাত্রজ পাবলিকেশনের বাড়িতে তাঁর জন্ম। সুব্রত জানালেন, বইটি ২০১২ সালে প্রকাশিত হওয়ার দু'বছরের মধ্যেই ফুরিয়ে যায়।

"শান্তি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ার কারণ কী কী, এটা সে সম্পর্কিত বই ছিল। বইটা এক অর্থে টেম্পোরাল ছিল বলে আমরা আবার ছাপি নি। তবে ফের ছাপার একটা কথা চলছে," বলছিলেন সুব্রত। সেতু ঠিক কী ধরনের বই ছাপে? সুব্রত বললেন, "ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, জেন্ডার স্টাডিজ ও পরিবেশ, এই বিষয়গুলিকে মূল লক্ষ্য হিসেবে রেখে অ্যাকাডেমিক ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের বই প্রকাশ করে থাকি। একটু বড় করে বলতে গেলে, আমরা সবরকমের বই প্রকাশের পক্ষে, কিন্তু আমরা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর বলে যা বিশ্বাস করি, তেমন বই ছাপব না।"

"এ বইতে যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই মাওবাদীদের পথের সমালোচনা করেছেন," বলছিলেন বিশ্বজিৎ। তিনি নিজেও সেই সমালোচনার অন্যতম ধারক। তথাকথিত মুক্ত লাল অঞ্চলে যে সন্ত্রাস মাওবাদীরা নামিয়ে আনে, তা কোনওভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। মনে করিয়ে দিচ্ছেন সালকু সোরেনের কথা, জঙ্গলমহলে যে গরিব সিপিএম কর্মীকে পুলিশের চর সন্দেহে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল মাওবাদীরা। কিন্তু তিনি ভুলছেন না, চিদাম্বরম যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সে সময়ে মাওবাদী নেতা আজাদের হত্যা নিয়ে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তোলপাড় করেছিলেন, কিন্তু সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর আমলে কিষেণজি কীভাবে নিহত হলেন, তার বিবরণ পাওয়া গেল না।

প্রথমে কংগ্রেস, তারপর সিপিএম, তারপর তৃণমূল, এবার সামনে সম্ভাব্য বিজেপি শাসনে পরিস্থিতি যে কোথাও বদলায় না, রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের যে কাঠামো, তাকে প্রশ্ন করার মানেই যে খাতায় নাম তোলানো, সে কথা বলার পরেও বিশ্বজিৎ বলছেন, "সোনিয়ার আমলে রাখঢাক ছিল কিছু। এখন মোদীর সঙ্গে রয়েছে আরএসএস ব্র্যান্ডের হিন্দুত্ব আর আদানি-আম্বানিদের পুঁজিবাদ, যেমনটা আগে দেখা যায় নি।" বিশ্বজোড়া এই ধরনের দক্ষিণপন্থী মতাদর্শ মাথা চাড়া দেওয়ায় গণতান্ত্রিক পরিসরেরও ভুবন জুড়ে বিপন্নতা বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।

বিশ্বজিতের কথায়, "বিপন্ন ঘরে-বাইরে সকলেই। সাংবাদিকদের একসময়ে বলা হত পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল। সিভিল সোসাইটির তাঁরা স্বর। কিন্তু গোটা দেশে সাংবাদিকদের এবং সংবাদমাধ্যমের কী পরিস্থিতি, দেখুন। নাম ধরে ধরে বলা যায়, একসময়ে যেসব সাংবাদিকরা সিস্টেমের বিরুদ্ধে ক্রমাগত কথা বলে গিয়েছেন, শুধু পেশায় টিঁকে থাকবার তাগিদে তাঁদের কীভাবে কাজ করতে হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।"

উল্লেখযোগ্য তথ্য - এ বইটি উৎসর্গ করা হয়েছিল সমর সেনের স্মৃতিতে। 'ফ্রন্টিয়ার' পত্রিকার সম্পাদক সমর সেন। এবং "এ বইয়ের রয়্যালটির কোনও অর্থ সম্পাদক বা লেখকরা নেন নি, পুরো টাকাটাই গিয়েছিল ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার তহবিলে," জানালেন সুব্রত, যাঁর নিজের প্রকাশনা ব্যবসা শুরু হয়েছিল স্ত্রীর গহনা বিক্রির অর্থে।

“আমি কাল রাতে ভাবছিলাম, যদি ভোর রাতে ওরা আসে, তাহলে কী কী বই পেতে পারে? আমার কাছে প্রচুর মাওইস্ট লিটারেচর আছে, গান্ধী আছে, গোলওয়ালকর রয়েছে, আছে রামচরিত মানসও। ঠিক কোন বই না পড়লে, বাড়িতে বা নিজের কাছে না রাখলে নিরাপদে থাকা যাবে?” প্রবীণ সাংবাদিকের এ প্রশ্ন শ্লেষ ছিল না কি কাতরতা, সে নিয়ে সংশয় থেকেই গেল।

Maoist naxal
Advertisment