West Bengal CPM: চলে গেলেন বঙ্গ সিপিএমের অন্যতম প্রধান পরামর্শদাতা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও দলের প্রাক্তন পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর আমলেই ২০০৬ বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম ২৩৫টি আসনে জয়ী হয়েছিল। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে যাদবপুর কেন্দ্রে ব্যাপকভাবে পর্যদুস্ত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বিগত দুই সংসদীয় নির্বাচনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দেখেছেন দলের চূড়ান্ত দৈন্যদশা। আপাতত গভীর সঙ্কটে বঙ্গ সিপিএম নেতৃত্ব। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচন থেকে রক্তক্ষয় চলছে তো চলছেই। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের পর ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনেও এরাজ্যে শূন্য থেকে গিয়েছে সিপিএম।
অসুস্থ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে নানা বিষয়ে পরামর্শ নিতে যেতেন সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব। বঙ্গ সিপিএম নেতৃত্বের যে গভীর সংকট দেখা দিয়েছে তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কোনও দ্বিমত নেই। কবে এই সংকটের নিরসন ঘটবে, তা বলা মোটেই সহজ নয়। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে আত্মসমীক্ষা করেছেন দলের নেতৃবৃন্দ। কমিউনিস্ট পার্টিতে যে কোনও নির্বাচনের পরে আত্মসমীক্ষা বা বিশ্লেষণ নতুন কিছু বিষয় নয়। যে কোনও রাজনৈতিক দলই এমন বিশ্লেষণ করে থাকে। তবে এবারে পরাজয়ের কারণ খোঁজাটা অত্যন্ত জরুরি। দেশে ইন্ডিয়া জোট যেখানে বিজেপিকে একটু হলেও চাপে রেখেছে সেখানে একটি লোকসভা আসনও জোটেনি সিপিএমের।
বরং একটি আসন পেয়ে জোটের মান রেখেছে কংগ্রেস। অথচ ২০২৩ গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভয়াবহ সন্ত্রাসের মধ্যে কয়েকটি জেলায় সিপিআইএমের প্রাপ্ত ভোটের হার আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু লোকসভায় সিপিআইএমের প্রাপ্ত ভোট মাত্র ৬ শতাংশ। এরাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ BJP। সেই স্থান সিপিএম আদৌ নিতে পারবে? সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। কংগ্রেসকে জোটে নিয়েই চলতি লোকসভায় বহু আসনে জামানত খুইয়েছে সিপিএম।
আরও পড়ুন- Buddhadeb Bhattacharjee last rites live update: বুদ্ধবাবুর স্ত্রীকে ফোন রাহুল গান্ধীর, কী কথা হল?
সিপিএমের প্রধান প্রতিপক্ষ কে বিজেপি না তৃণমূল কংগ্রেস? এই গবেষণা চলছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। ২০০৮ সালে UPA সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার পরে যে কারণ দেখানো হয়েছিল তার মধ্যেও ধোঁয়াশা ছিল। সাধারণ মানুষের কাছে সেই কারণ বোধগম্য হয়নি। বরং তৎকালীন লোকসভার অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের অবস্থানকে বাঙালি অনেক বেশি সমর্থন করেছিল। সেক্ষেত্রে দলের একাংশ প্রকাশ্যে না বললেও সোমনাথবাবুর সিদ্ধান্তের পাশে ছিলেন।
আরও পড়ুন- Buddhadeb Bhattacharjee: বামেদের মধ্যে সংস্কারের চেষ্টা, তাতেই কি ডুবে গিয়েছিল বুদ্ধদেবের সরকার?
প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিনয় চৌধুরী, হরকিষান সিং সুরজিৎ, জ্যোতি বসুরা সরে যাওয়ার পরে সেই শূন্য স্থান কীভাবে পূরণ হয়েছিল? ময়দানের নেতৃত্ব ছিল না। তাঁদের অনেকেই ছিলেন টেবিল পলিটিসিয়ান। তার একটা প্রতিক্রিয়া থাকবেই। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম বিমান বসু। এবারেও সিপিএমের প্রচারসভায় ভিড় লক্ষ্য করা গিয়েছে। কিন্তু ভোট বাক্সে তার ফল মেলেনি। একটা সময় গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষের সমর্থন নিয়েই সিপিএম শক্তিশালী হয়েছিল।
সেই মানুষগুলো এখন আর লাল পতাকার তলায় একজোট হচ্ছে না। কেউ কেউ মিছিলে গেলেও ভোট দিচ্ছে না সিপিএমকে। কিন্তু এই শ্রেণির মানুষজন ভালো করেই জানেন শাসকদলের সঙ্গে থাকলেই তাঁরা লাভবান হবেন। সরকারি সুযোগ সুবিধা, কর্মসংস্থান হবে। এর আগে বাম আমলেই ধনীপ্রীতি বা শিল্পপতিদের সঙ্গে মেলামেশা বেড়েছিল সিপিএম নেতৃত্বের বড় অংশের। এই দৃশ্য অনেকের কাছে ভালো ঠেকেনি। তাছাড়া সিপিএম এমন আশা জাগাতে পারেনি যে ২০২৪-এ লোকসভায় একাধিক আসন পেয়ে ২০২৬-এ বাংলায় প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে। তাই যা হওয়ার হচ্ছে। সিপিএম নেতৃত্ব কিছুতেই জট খুলতে পারছে না।
সিপিএম নেতৃত্ব বলতেন, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা। গ্রামের মানুষের সমর্থন পেয়েই টানা সরকার গড়েছে বামফ্রন্ট। বাম জমানাতেই নির্বাচনে জেলা বা মফস্বলে ভাল ফল করলেও কলকাতায় একাধিক বিধানসভা আসনে টানা হেরেছে সিপিএম তথা বামেরা। এমনকী বাংলার শহরাঞ্চলেও কম ভোট পেত সিপিএম। এমনও দেখা যেত শহরে হেরে 'ভূত' হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ওই আসনের গ্রামীণ ক্ষেত্রে গণনা শুরু হতেই সিপিএমের জয়জয়কার শুরু হয়ে যেত। গ্রামই রক্ষা করত সিপিএমকে।
এখন সেই গ্রামবাংলাও পুরোপুরি সরে গিয়েছে সিপিএমের কাছ থেকে। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বেই বঙ্গে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে দল এগিয়ে গিয়েছে। শেষলগ্নে বিপদ আঁচ করে তিনি বলেছিলেন, সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হবে। মূলত বয়সের ভারে, অসুস্থাতার কারণে জ্যোতি বসু সরে দাঁড়াতেই নেতৃত্বের সংকট শুরু হয় সিপিএমের। যা এখন গভীর সংকটে পরিণত।
সিপিএমের প্রচার এখন অনেক বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ও টেলিভিশনে দেখা যায়। মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছানোর থেকে এই সব মাধ্যমের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা সিপিএমের। যুব নেতা থেকে অনেকেই সকাল-সন্ধ্যে টিভির পর্দায় বসে পড়েন। রাজনৈতিক মহলের মতে, এই দুই মাধ্যমের থেকে যদি আগের সিপিএমের মতো সাধারণ মানুষের সুখে-দুঃখে তাঁরা মাঠে-ঘাটে থাকতো তাহলে অনেক বেশি লাভবান হতে পারতেন। দল ক্ষমতায় থাকার সময় ছাত্র-যুব নেতৃত্ব সংঘটিত থাকলেও তাঁদের সিপিএম নেতৃত্বে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যাও দু'একজনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছে সিপিমের মতাদর্শকে ঠুকরে দিয়ে। তবে বিগত দুই নির্বাচনে দেখা গিয়েছে ছাত্র-যুবদের।
তাঁরা নতুন করে পথ খুঁজতে রাস্তায় নেমেছেন। বেশ কয়েকজন উজ্জ্বল মুখ রয়েছে সিপিএমের। তাঁরা বাম আন্দোলনের ভবিষ্যৎ হতে পারেন। কেন সিপিএম ব্যর্থ হচ্ছে? সেই কারণ এঁরাই খুঁজে বের করতে পারেন। এঁরা নির্বাচনে লড়াই করে পরাজিত হলেও অভিজ্ঞ হয়েছে, রাজনীতির ফাঁকফোকর খুঁজছে। সিপিএম নেতৃত্বের গভীর সঙ্কটের মরুদ্যানে এরাই বৃষ্টি আনতে পারে। বুদ্ধদেব ভটাচার্য দেখে গেলেন সিপিএমের ঠুনকো নেতৃত্বকে।