Advertisment

বর্ধমানের 'বিজয় তোরণে'র সামনে বসছে রাজা-রানির মূর্তি, তুঙ্গে বিতর্ক

কেন রাজা, রানির মূর্তি বসানো হবে? ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বহু ইতিহাসবিদ।

author-image
Joyprakash Das
New Update
burdwan city vijoy toran karjon gate statues of king and queen controversy

বর্ধমানের অন্যতম পরিচিতি এই কার্জন গেট। যার সামনেই বসতে চলেছে মূর্তি।

১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের জন্য আমবাঙালির কাছে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন লর্ড কার্জন। লর্ড কার্জন ১৮৯৯ সাল থেকে ছয় বছর ভারতের ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁরই সম্মানার্থে বর্ধমান শহরে এখনও দৃঢ় চিত্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১১৯ বছরের কার্জন গেট। যদিও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সেই গেট পরিচিত হয় বিজয় তোরণ নামে। তবে এবার ঐতিহ্যবাহী এই তোরণের সামনেই বসছে বর্ধমানের রাজা-রানির মূর্তি। তা নিয়েই তৈরি হয়েছে তুমুল বিতর্ক।

Advertisment

বিজয় তোরণের (কার্জন গেট নামেও পরিচিত) সামনে বর্ধমানের মহারাজা বিজয় চাঁদ মহাতাব এবং তাঁর স্ত্রী রাধারানির একটি মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্ধমান পুরবোর্ড। কার্জন গেটই শহরের প্রধান ল্যান্ডমার্ক। ১৯০৩-এ লর্ড কার্জন যখন শহরে এসেছিলেন তাঁর সম্মানে মাহাতাব গেটটি তৈরি করেছিলেন। তবে কার্জন গেটের সামনে রাজা-রানির মূর্তি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ডের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনীতিবিদদের একাংশের পাশাপাশি ইতিহাসবিদ ও পুরাতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরাও প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ দাবি করেছেন যে রাজা ও রানির মূর্তি তৈরি হলে মূল কাঠামোটি আর দেখা যাবে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, বিজেপির হিন্দুত্ববাদের মোকাবিলা করতেই এটা তৃণমূলের নয়া কৌশল। স্থানীয় বিশিষ্টদের মূর্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রাদেশিক ভাবনা উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে শাসকদল। তবে শহরের বিশিষ্টদের একাংশ মূর্তি বসানোর পক্ষে রায় দিচ্ছেন।  

বর্ধমান পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার এই মূর্তিগুলির উন্মোচন করা হবে। পুরসভার চেয়ারম্যান পরেশ সরকার বলেন, “মূলত স্থানীয় বিধায়ক খোকন দাসের উদ্যোগে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কার্জন গেটের সামনে মূর্তি স্থাপন ঘিরে বিতর্কের বিষয়টি নিয়েও আমরা অবগত।” বিজয় চাঁদ মাহাতাবের কথা বলতে গিয়ে চেয়ারম্যান পরেশ সরকার আরও বলেন, “তিনি এই গেটের প্রধান স্থপতি। বর্ধমান শহরের প্রধান স্থপতিও তিনিই। তাই কার্জন গেটের সামনে তাঁর মূর্তি তৈরি হলে বিতর্ক কেন হচ্ছে?।'' অন্যদিকে, স্থানীয় বিধায়ক খোকন দাস বলেন, “বর্ধমান শহরের বেশিরভাগ এলাকাই বর্ধমানের মহারাজার দখলে ছিল। সুতরাং তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর মূর্তি তৈরিতে কোনও দোষ নেই। বিসি রোড, যেখানে মূর্তিটি তৈরি হচ্ছে এবং কার্জন গেট উভয় এলাকা তাঁর আমলেই তৈরি হয়েছিল।”

publive-image
মূর্তি বসানোর প্রস্তুতির কাজ চলছে।

রাজ্যের বিরোধী দলগুলি মূর্তি বসানোর সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করছে। বিজেপি নেতা রাহুল সিনহা বলেন, “তৃণমূল বাংলার সংস্কৃতি নষ্ট করেছে। তাঁরা এখন মূর্তি তৈরি করে মানুষকে খুশি করার চেষ্টা করছে। জনগণ বুঝতে পেরেছে যে তাঁরা এই ধরনের শো-অফের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে।” অন্যদিকে, সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, "ঐতিহ্যের কাঠামো নষ্ট করার চেষ্টা করা দুর্ভাগ্যজনক।"

কার্জন গেট ডিজাইন করেছিলেন স্থপতি নরেশ চন্দ্র বসু। তাঁর বড়-ভাইপো দেবাশিস বসু বলেন, “একটি ঐতিহ্যবাহী স্মৃতিস্তম্ভের সংযোজন বা পরিবর্তন শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের পরেই করা উচিত। অন্যথায়, এই ধরনের হস্তক্ষেপ মানহানির সমান। কার্জন গেট নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহ্যবাহী স্মৃতিস্তম্ভ। এই সংক্রান্ত যে কোনও পরিকল্পনা হেরিটেজ বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। এটা আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে বেদনাদায়ক। কারণ, গেটটি আমার পিতামহের বড় ভাইয়ের পরিকল্পিত এবং ডিজাইন ছিল।”
নৈহাটির ঋষি বঙ্কিম চন্দ্র কলেজের অধ্যাপিকা ইতিহাসবিদ কাকলি মুখোপাধ্যায় বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মাহাতাবকে সম্মান জানিয়েও এই পদক্ষেপ নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর কথায়, “কার্জন গেটের ঐতিহ্যের মূল্য আছে। বিজয় চাঁদ মহাতাব শুধু লর্ড কার্জনকে স্বাগত জানাতেই কার্জন গেট তৈরি করেননি বরং এটি ছিল তাঁর রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান। তিনি এবং তাঁর পরিবার ব্রিটিশদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নীতির সম্পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিশদের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র থাকা সত্ত্বেও, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র এবং নিরস্ত্র আন্দোলন উভয়ই এই ছোট শহরে গতি পেয়েছিল। স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তিতে কেন আমরা তাঁর মূর্তি স্থাপন করব? আমার মনে হয়, রাজার বদলে বর্ধমানের মাটির সন্তান কাজী নজরুল ইসলামের মূর্তি তৈরি করা উচিত ছিল।''

পুরাতাত্বিক গবেষক সর্বজিৎ যশ অব্শ্য মহারাজা-মহারানির মূর্তি বসানোয় খুশি। তিনি বলেন, “এটা ভালই উদ্যোগ। তাছাড়া মূর্তি বসানোয় তোরণের যে কারুকার্য দেখা না যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে তা গেট তৈরির সময়ে হয়নি। ওই কারুকার্য ৭০ দশকে তৈরি। সব থেকে বড় কথা সরকারি ভাবে হেরিটেজের তকমাও জোটেনি বিজয় তোরণের। দীর্ঘ দিন ধরে আমরা দাবি জানিয়ে এসেছি, হেরিটেজ ম্যানুয়াল তৈরি করার। সে ব্যাপারেও কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।”

West Bengal East Burdwan burdwan
Advertisment