Civic Volunteer's School: সিভিক ভলান্টিয়ার। আরজি কর কাণ্ডের পর থেকে এই পেশা নিয়ে অনেকেই নাক কুচকান। আসলে এই চাকুরিজীবীদের নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে এদের একাংশের কাজকর্মের জেরে নানারকম প্রশ্নচিহ্ন উঠেছে নাগরিক সমাজে। তবে সবাই যে সঞ্জয় রাই হয় না তাঁর জলজ্যান্ত প্রমাণ হুগলির হীরালাল সরকার। পেশায় তিনি বলাগড় থানার সিভিক ভলান্টিয়ার। তাঁর দায়িত্ব এসটিকেকে (অসম লিঙ্ক) রাজ্য সড়কের নাটাগড় মোড়ে ট্রাফিক সামলানো।
কিন্তু এই ট্রাফিকের কাজ করার পাশাপাশি আরেকটি কাজও তিনি করেন। সেটি হল লাগোয়া গ্রামের গরিব শিশুদের পড়ানো। নাটাগড় মোড়ের কাছে পাটকাঠি, খড়, মাটি দিয়ে তৈরি একটি ছোট্ট চালাঘর। রাস্তার ধারে এই চালাঘরটি নিজ উদ্যোগে বানিয়ে ফেলেন হীরা। মাসছয়েক আগে থেকেই শুরু। প্রথমে দু-একজন থেকে বর্তমানে প্রায় জনা ২০ কচিকাঁচা ভেড়ে এই পাটকাঠির পাঠশালায়। নাটাগড় মোড়ের কাছেই নাটাগড় আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এলাকাটি আদিবাসী অধ্যুষিত। মূলত গরিব দিনমজুর শ্রেণির বসবাস। হীরার কথায়, "আমি দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করতাম এই শিশুগুলিকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে তাঁদের বাবা-মা দিনমজুরি খাটতে বেরিয়ে যায়। তাই এদের পড়াশোনা বলতে শুধু বিদ্যালয়ে যতক্ষন ততক্ষণ। তাই আমি ভাবলাম তাদেরকে যদি একটু টিউশন দেওয়া যায়..।" সেই শুরু। মাস ছয়েক আগেই গ্রামের লোকের কাছে চেয়ে চিন্তে কিছুটা নিজের পকেট থেকে দিয়ে বানিয়ে ফেলেন একটি ছোট্ট চালাঘর। উদ্দেশ্য সেখানে বাচ্চাদের নিয়ে লেখাপড়া শেখানো। এর জন্য নিজের কাজের মধ্যে থেকেই সময় বার করে নিয়েছে ওই যুবক। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে পৌনে ১১টা অবধি সে কচিকাঁচাদের নিয়ে বসে।
মূলত প্রাথমিক স্তরে শিশুশ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি অবধি ছাত্রছাত্রীদের তাদের বাড়ির লোকই এই পাঠশালায় দিয়ে আসে। এখানে তাদের পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক শিক্ষায় দীক্ষিত করার চেষ্টা করে হীরা। "এই ক্লাস করে আমাদের স্কুলের পড়াটাও অনেক সহজ হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি।" জানায় রীমা সোরেন, জয়া সোরেন, মালা টুডুরা। এরা কেউ আদিবাসী স্কুলের তৃতীয় শ্রেণি কেউ চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলে তো মিড-ডে মিল পায় এখানে কিছু পাবে না? নিজের সাধ্যমত লজেন্স, বিস্কুট নিয়ে আসে হীরা।
আরও পড়ুন অশুভের বিনাশে এগাঁয়ে নাকি বন্দুক ধরেছিলেন স্বয়ং মা দুর্গা, আজও এপুজোয় চলে গুলি
নিজেও প্রান্তিক পরিবার থেকে উঠে আসা। জিরাট কলেজ থেকে বি এ পাস করে অন্যকিছু চাকরি না পেয়ে সিভিকে ঢোকে হীরা। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা ছাড়াও আছে দাদা। বিয়ে করার পর ফুটফুটে মেয়ের বাবাও সে। বাবার কাঁচা আনাজপাতির দোকান সোমড়াবাজার এলাকায়। প্রতিদিন ভোর চারটার সময় উঠে বাইক নিয়ে তাঁর সোমড়াবাজারের বাড়ি থেকে কয়েক মাইল দূরে গুপ্তিপাড়ায় গিয়ে কাঁচা আনাজ কিনে বাবার দোকানে দিয়ে এসে তাঁর দিন শুরু করে। আবার বিকেলে কাজ থেকে ফিরে নিয়ম করে বাবার দোকানে বসা। এমনিভাবে কেটে যায় সারাদিন।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ৩৬ বছরের যুবকটি স্বপ্ন দেখে মানুষ গড়ার। তাঁর এই কর্মকাণ্ডকে কুর্নিশ জানিয়েছেন পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরাও। বলাগড় থানার অফিসার-ইন-চার্জ রাজকিরণ মুখোপাধ্যায় থানায় ডেকে সম্বর্ধনা দিয়েছেন সম্প্রতি। হুগলি গ্রামীণের পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন উৎসাহিত হীরালাল সরকারের এই কর্মকাণ্ডে। হুল নয়, ফুল ও ফোটানো যায় শুধু দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। সেটাই দেখিয়ে দিয়েছে হীরালাল তাঁর ভবিষ্যতের হীরে তৈরির কারখানা খুলে।।