কলকাতাসহ সারা রাজ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ মহাসংকটে। একে করোনা আবহে লকডাউনের প্রেক্ষিতে লোকসানের বিপুল বোঝা তারওপর ডিজেলের অস্বাভাবিক মল্যবৃদ্ধি পরিবহণ শিল্পকে তলানিতে নিয়ে গিয়ে ঠেকিয়েছে। ক্রমাগত রাস্তায় বাস ও ট্রাকের সংখ্যাও কমে গিয়েছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। অতিরিক্ত ভাড়া গুণলেও সময়মত বাস মিলছে না রাস্তায়।
বাসের ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে লাগাতার আন্দোলন করছেন বাসমালিকরা। রাজ্য সরকার ভাড়া না বাড়িয়ে বিকল্প পথের কথা ভাবছে। যদিও বাসের ভাড়া বেশি নেওয়া হচ্ছে যাত্রীসাধারণের কাছ থেকে। গতবছর লকডাউন ওয়ানের পর ঘোষণা ছাড়া ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে প্রথমে যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেও এখন তা প্রায় উবে গিয়েছে। বাসমালিকদের কথায়, তাঁরাও উপলব্ধি করতে পারছেন। জ্বালানির ভাড়ার বহরে বাসমালিকরাও দিশেহারা কোন পদ্ধতিতে বাসের ভাড়া ঠিক করা হবে তা নিয়ে। বাসমালিক ও ট্রাক সংগঠনের মালিকদের বক্তব্য, তাঁদের ব্যবসা ক্রমশ কোমায় চলে যাচ্ছে।
পেট্রলের পর ডিজেলও সেঞ্চুরি পার করেছে। যদিও পরে কিছুটা কমিয়েছে কেন্দ্র। জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটের সাধারণ সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'গত দুবছর ধরে কোভিডের যন্ত্রনায় বাস রাস্তায় নামতে পারেনি। আর অন্যদিকে ডিজেলের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি যাত্রী পরিবহণকে কোমায় পাঠিয়ে দিয়েছে। কোমা থেকে সাধারণ বেডে আনতে গেলে রাজ্য সরকার নমিনাল শেয়ার ঘোষণা করলে হবে না। পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট বাড়ার ফলে এই রাজ্যে টায়ারসহ গাড়ির যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে। এসব এই রাজ্য়ে প্রো়ডাকশন হয় না। একজোড়া টায়ারের দাম ছিল ৩৪ হাজার টাকা এখন তা হয়েছে ৩৯ থেকে ৪২ হাজার টাকা।'
কলকাতাসহ রাজ্যে রাস্তায় বাসের সংখ্যা ক্রমশ কমে গিয়েছে। তপনবাবুর দাবি, 'রাজ্যে মোট বাস চলে ৪২ হাজারের মত। কলকাতায় গাড়ি চলে সাড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার। এখন সেখানে ৭০ শতাংশ বন্ধ। ৩০ শতাংশ গাড়ি রাস্তায় নেমেছে। ২ বছরের ওপর ঋণ শোধ করতে পারছে না বাসমালিকরা। কৃষির পরে মানুষ সব থেকে বেশি পরিবহণে কাজ করে। যে ইলেকট্রিক বাসের দাম ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা। এই বাসের পরিকাঠামো এই রাজ্যে নেই। বেসরকারি পরিবহণ তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।' ওয়েস্ট বেঙ্গল বাস ও মিনিবাস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ নারায়ণ বসু বলেন, 'কলকাতায় সাড়ে ৬ হাজার গাড়ি। এখন গাড়ি ৫০ শতাংশে দাড়িয়েছে। এখন ২ হাজার গাড়ি চলছে। ইনসিওরেন্স জমা করতে পারছে না। তাহলে ট্যাক্স হবে না, সিএফটি হবে না। ইএমআই দিতে পারছে না। কাগজপত্র আপডেট করতে পারছে না।'
কীভাবে সম্ভব এই সমস্যা থেকে সমাধানের? প্রদীপবাবু বলেন, 'স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের মত ক্রেডিট কার্ড দিলে বাসমালিকরা বেঁচে যাবে। অল্প সুদে ২ লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ টাকা ক্রেডিট দিলে আপাতত বাসগুলি রাস্তায় নামতে পারবে। সরকার বিকল্প ভাবছে। আমরা ৮৫ শতাংশ গাড়ি সার্ভিস দিই। সরকার ভাবছে ব্যাটারি বা সিএনজিতে কনভার্ট করে দেবে। সরকার সাহায্য করবে বলে পরিবহণমন্ত্রী জানিয়েছে।' আদৌ বাস্তবে পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা নিয়ে সন্দিহান সাধারণ বাসমালিকরা।
কলকাতার রাস্তায় অটো ইউনিয়ন নিজেদের মতো ভাড়া ঠিক করে নেয়। এক্ষেত্রে সরকারি কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। লকডাউনের পর সব রুটেই অটো ভাড়া বেড়েছে। বাসের ক্ষেত্রে ভাড়া ঠিক করে রাজ্য সরকার। কিন্তু লকডাউনের পর রাজ্য সরকার ভাড়া না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেও বাসমালিকরা ভাড়া বাড়িয়েছেন। যা এখন কার্যত পরিস্থিতি বিচার করে মেনেও নিয়েছেন। এখন বাসমালিকরাও বাসের ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে দিয়েছেন। এখন কলকাতায় সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। তপনবাবুর কথায়, '১৯৭৫ সালে ভাড়া ছিল ১০ পয়সা। জ্ঞান সিং সোহনপাল ছিলেন পরিবহণমন্ত্রী। তখন ডিজেল ছিল ৮০ পয়সা। এখন তেলের দাম কত? ভাড়া কত? একের পর এক কমিটি হলেও তাতে কোনও কাজ হয়নি।' এদিকে প্রদীপ নারায়ণ বসু বলেন, 'তেলের দাম শেষ কোথায় জানি না। তেলের দাম ১০৫ টাকা হলে নিজেরাই দাম বাড়াব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু ১১ টাকা ৭০ পয়সা কমানোয় এখন তা করছি না। ১০ টাকাই থাকবে।' বাসমালিকদের দাবি, 'সরকার ভর্তুকি দিয়ে বাস চালাচ্ছে। আমাদের কে ভর্তুকি দেবে?'
শুধু যাত্রী পরিবহণ কোমায় যায়নি। পণ্য পরিবহণও কোমায় চলে গিয়েছে বলে দাবি করেছেন ট্রাক মালিকরা। তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে একাধিক কারণ রয়েছে এর পিছনে। ফেডারেশন অফ ওয়েষ্ট বেঙ্গল ট্রাক অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সজল ঘোষ বলেন, 'তেলের দাম আরও কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। সারা ভারতেই পণ্য পরিবহণ কোমায় চলে গিয়েছে। সারা পশ্চিমবঙ্গে শিল্প বলে কোনও জিনিস নেই। বাইরের ট্রাকগুলো বাংলাদেশ বর্ডারে আটকে রয়েছে। গাড়ির মালিক ট্রেড ব্যবসায় সরে যাচ্ছে। ইনসিওরেন্স, ট্যাক্স ভরতে পারছে না। শুধু অত্যাবশ্যকীয় পণ্য পরিবহণ হয়েছে লকডাউনে। এছাড়া রয়েছে পুলিশের জুলুম।' তার প্রশ্ন কিভাবে বাঁচবে এই শিল্প?
রাস্তায় যেভাবে বাস কমে গিয়েছে ট্রাকের ক্ষেত্রেও সেই একই হাল। লকডাউন ও তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ট্রাক ব্যবসায়ীরা জীবিকার জন্য পথ বদলে ফেলছেন। সজলবাবুর বক্তব্য, 'রাজ্যে ৭ লক্ষ ২৬ হাজার ট্রাক আছে। সেখানে ৬০ শতাংশ ট্রাক চলছে। কেউ ইএমআই দিতে পারছে না। তেলের দাম হওয়া উচিত ৪৪-৪৫টাকা, সেটা ১০০ টাকায় পৌছে গেল। প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলি এত কম টাকায় তেল দিচ্ছে। ভ্যাকসিন থেকে চাল সমস্ত ভর্তুকি তেলের টাকায় দিচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। ব্যাটারি, গ্যাস বা ইলেকট্রিকে হেভি গাড়ি চলবে না। ইঞ্জিন কনভার্ট করতে হবে। এবার ওয়াগানে নিয়ে এসে ছোটগাড়ি দিয়ে পরিবহণ সামলাবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ১ কোটি মানুষের জীবিকা এখন সংকটে।'
বাস ও ট্রাক মালিকরা চাইছে ডিজেলে জিএসটি বসাক সরকার। কয়েকটা রাজ্য মানেনি। এটাও চালাকি বলে মনে করছে তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, '২০২৪-এর নির্বাচনের আগে জিএসটি বসাবে সরকার। মোদ্দা কথা পরিবহণ শিল্পকে এখন টেনে তোলাই দায়। এতে একদিকে যেমন ভুগছে বাস ও ট্রাক মালিকরা অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ভোগান্তিরও যেন শেষ থাকছে না।
আরও পড়ুন- কেন্দ্রের আবেদনে সাড়া, জ্বালানি তেলে ভ্যাট কমাল ২২ রাজ্য, তালিকায় নেই পশ্চিমবঙ্গ
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন