চলতি মরশুমে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং মাকালুর দুর্ঘটনা ভারাক্রান্ত করেছে বাংলার পর্বতারোহী এবং অ্যাডভেঞ্চার পাগল মানুষের মন। কুন্তল কাঁড়ার এবং বিপ্লব বৈদ্যের মৃত্যুর মর্মান্তিক খবরের রেশ কাটার আগেই এসেছে মাকালু থেকে পর্বতারোহী দীপঙ্কর ঘোষের নিখোঁজ হওয়ার খবর। কুন্তল এবং বিপ্লবের দেহ উদ্ধার হয়েছে। আজ পাঁচদিন ধরে নিখোঁজ দীপঙ্কর ঘোষ। এরই মধ্যে মঙ্গলবার ফের রাত জাগবে বাংলা। চন্দন নগরের মেয়ে পিয়ালি বসাক তৈরি হচ্ছেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পা রাখার জন্য। একই সঙ্গে মঙ্গলবার এভারেস্ট, বুধবার লোৎসে শৃঙ্গে পা রাখার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন পিয়ালি। তবে শেষ পাঁচ দিনের ঘটনাক্রম বদলে দিয়েছে অনেক কিছু। তাই পিয়ালির জন্য উত্তেজনার চেয়ে এখন অনেক বেশি উৎকণ্ঠায় বাংলা। বাংলার পর্বতারোহণের এই ঘোর দুঃসময়ে প্রশ্ন উঠছে অনেক। একই সঙ্গে এভারেস্ট এবং লোৎসে, দুটি আট হাজারি উচ্চতার শৃঙ্গে পর পর আরোহণের চেষ্টা কি একটু বেশিই বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে না?
আরও পড়ুন, আবহাওয়া প্রতিকূল থাকায় মাকালুতে দীপঙ্কর ঘোষের উদ্ধারকাজ ব্যাহত
সম্প্রতি বাংলার প্রথম সারির পর্বতারোহী দেবব্রত মুখোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন সোশাল মিডিয়া সাইটে। সাপ্লিমেন্টারি অক্সিজেন সাপোর্ট ছাড়া বিশ্বের উচ্চতম এবং চতুর্থ উচ্চতম শৃঙ্গে আরোহণ করার পরিকল্পনা ছিল পিয়ালির। পোস্টটি মূলত ছিল সেই নিয়েই। দেবব্রতবাবু এই ঝুঁকির কথা ভেবেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হলে পিয়ালির বোন তমালী জানান, " গত বছর মানসলু অভিযানের সময় পিয়ালির মাস্কে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, সেটা শেরপারা বুঝতে পারেননি। পরে যখন বোঝা গেল, তখন অক্সিজেন ছাড়াই বহুক্ষণ কাটিয়ে দিয়েছে ওই উচ্চতায়। সেখান থেকেই অক্সিজেন সাপোর্ট ছাড়া এভারেস্ট অভিযানের কথা মাথায় আসে। তবে অক্সিজেন সঙ্গে রাখছে, দরকার পড়লেই তা ব্যবহার করবে পিয়ালি।
একই সঙ্গে পর পর দু'দিন এভারেস্ট এবং লোৎসে ক্লাইম্ব করা নিয়ে উদ্বিগ্ন পর্বতারোহী দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। বললেন, "এভারেস্ট সামিট মার্চে যদি মঙ্গলবার বিকেল থেকে শুরু হয়, বুধবার ভোরে শৃঙ্গ ছুঁয়ে খুব তাড়াতাড়ি নামার চেষ্টা করলেও ১০ টা সাড়ে ১০ টা বেজে যাবে। সেখান থেকে লোৎসে সামিট ক্যাম্প পৌঁছে যদি সামিট মার্চে করে, তারপর সামিট এবং নেমে আসা, সেক্ষেত্রে টানা দু'দিন এই ধকল নেওয়া সমতলের পর্বতারোহীদের জন্য এক রকম অসম্ভব। পিয়ালি যদি সেই পরিকল্পনা নিয়ে এগোয়, সেটা হবে সুইসাইডাল অ্যাটেম্পট। মাঝে একটা দিন বিশ্রাম নিয়ে অথবা এভারেস্ট শৃঙ্গ ছুঁয়ে ফিরে আসার পর বেস ক্যাম্পে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করা উচিত"।
আরও পড়ুন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও পাহাড়ের প্রতি ওঁদের কীসের এত টান?
অন্যদিকে বাংলার আরেক অভিজ্ঞ পর্বতারোহী বসন্ত সিংহ রায় বলছেন, "আমার মনে হয় মাউন্টেনিয়ারিং এথিক্সের বাইরে এটা। ছন্দা গায়েন যে বছর এভারেস্ট সামিট করতে যায়, ও আমায় বলেছিল লোৎসেও করবে একেবারে। আমি খুব বকা দিই। তৎক্ষণাৎ ও না করে দেয়। পরে আমি ধৌলাগিরিতে নিজে দুর্ঘটনার মুখে পড়ি, কাঠমান্ডুর হাসপাতালে দেখা করতে এসে ছন্দা জানায়, ও দুটোই ক্লাইম্ব করে, তখন খুব লজ্জা পেয়ে প্রথমে কান মুলে দিয়ে পরে আশীর্বাদ করে দিই। পরে ২০১৪ সালে কাঞ্চনজঙ্ঘার পর ওয়েস্ট পিক ক্লাইম্ব করার সময়েও মানা করেছিলাম। শুনল না। আর তো ফিরে এল না। পিয়ালিকে খুব বেশি চেনার সুযোগ আমার হয়নি। তাই ওর ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারব না। সবার শারীরিক দক্ষতা সমান হয় না। তবে একটা আট হাজারি শৃঙ্গ আরোহণের ওপর আমাদের মতো পর্বতারোহীরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন আরেকটা শৃঙ্গ আরোহণের ধকল নিতে পারে না শরীর। স্বাভাবিক ভাবেই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ে। এরা কেন এত ঝুঁকি নেয় জানিনা। যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করে ঝুঁকি নিতে হবে তো। স্পন্সরশিপ পাওয়ার বিষয়টা থাকে, জানি। তবে আমি কখনও এভাবে যেতাম না। নিজের আনন্দ হয় বলে পাহাড়ে যাই। সেখানে জীবনের ঝুঁকি নেব কেন। ওটার জন্যই তো এত কিছু"।
পিয়ালি হয়তো এতক্ষণে তাঁর ফাইনাল সামিট মার্চ শুরু করে দিয়েছেন। পিয়ালির জন্য রাত জাগবে সারা বাংলা। ৮৮৪৮ মিটার উচ্চতায় পরিস্থিতি কী, সমতলে বসে তার ছিটেফোঁটা আঁচও পাওয়া যাবে না। সেখানে সিদ্ধান্ত নিতে হবে পিয়ালিকেই। তবে নিরাপদে, সুস্থ শরীরে ঘরে ফিরুক মেয়ে, প্রতীক্ষায় গোটা রাজ্য।