Srijan Bhattacharya-CPIM: রাজ্যে দ্বিতীয় দফার নির্বাচন মিটেছে। প্রথম দফার নির্বাচন হয়েছিল গত ১৯ এপ্রিল, তারপর দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন হল ২৬ এপ্রিল। একেবারে শেষ দফায় আগামী ১ জুন নির্বাচন হবে যাদবপুর (Jadavpur) লোকসভা কেন্দ্রে। ১৯৮৪-তে এই কেন্দ্রে বর্ষীয়ান সিপিএম নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে (Somnath Chatterjee) পরাজিত করে হইচই বাধিয়ে দিয়েছিলেন প্রথমবার প্রার্থী হওয়া কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। এবার এই কেন্দ্রে সিপিএমের বাজি SFI-এর প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক ও সিপিএম নেতা সৃজন ভট্টাচার্য (Srijan Bhattacharya)। হেঁটে মানুষের দরজায় পৌঁছে যাচ্ছেন বামেদের এই তরুণ নেতা। কী কী কারণে এবার যাদবপুরে জয়ের 'স্বপ্ন' দেখছে CPIM? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সেটাই জানালেন সৃজন। ISF-এর প্রার্থী দেওয়া নিয়েও মুখ খুলেছেন বামেদের এই তরুণ তুর্কি।
প্রশ্ন: নির্বাচনের আবহেই কয়েক হাজার শিক্ষক চাকরি হারালেন আদালতের নির্দেশে। কী বলবেন?
সৃজন: প্রথম থেকে আমরা যোগ্য চাকরি প্রার্থীদের পাশে আছি। তাঁরা চাকরি করুন, চাকরি পান। কিন্তু যাঁরা তৃণমূলকে টাকা দিয়ে চাকরি জুটিয়েছিলেন, তৃণমূল আশ্বস্ত করেছিল বলে টাকাটা দিয়েছিলেন, তাঁদেরকে বলছি তৃণমূলের কোন নেতা টাকা নিয়েছিল তাঁর কাছে টাকা ফেরত চান। চাকরিও গেল, টাকাও গেল এই দুর্নীতির চক্করে পড়লে কত বড় সর্বনাশ হতে পারে সেটা এই রায়েই প্রমাণ। বেকারত্ব একটা জ্বলন্ত ইস্যু। এতে এমন দুর্নীতি হয়েছে যে চাল আর কাঁকড় বাছা যায়নি।
প্রশ্ন: যাদবপুরে টানা প্রচার করছেন। কী বুঝছেন?
সৃজন: মানুষের স্বতস্ফুর্ত চোখমুখ বলছে যাদবপুর এবার জিতব। সাতটা বিধানসভাতে তৃণমূলকে হারাব। যাদবপুরে জেতার মতো করে লড়াই করব।
প্রশ্ন: কেন জিতবেন বলে মনে করছেন? কী বলছেন মানুষকে?
সৃজন: জল, রাস্তা, আলো, নিকাশী, দুর্নীতি, তোলাবাজি, তৃণমূলের ওপর মানুষ বিরক্ত। জিনিষের দাম কমানো, বেকারত্ব। তাছাড়া যাদবপুর লোকসভার জন্য নির্দিষ্ট কিছু বিষয় আছে। ভাঙরে হাসপাতাল, চম্পাহাটিতে ফ্লাইওভার, সোনারপুরে হার্ডওয়ার পার্ক, সোনারপুরে হাসপাতাল করার চেষ্টা করব।
প্রশ্ন: কেমন সাড়া দিচ্ছে যাদবপুরের জনতা?
সৃজন: যাদবপুরের মানুষের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পাচ্ছি। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে ব্যাপক বিরক্তি আছে। আমি নিশ্চিত তরুণ প্রজন্ম বামপন্থীদের পাশে থাকবে।
প্রশ্ন: বিজেপি-তৃণমূল কি সত্যিই 'সেটিং'য়ে চলছে বলে মনে করেন?
সৃজন: হাইকোর্ট বলছে অথচ ইডি, সিবিআই অভিযুক্ত সাংসদের অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে বলছে না কেন? একটা সহজ কথা বলা দরকার। দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রী গ্রেফতার হয়ে যায় বাড়ি থেকে, ঝাড়খণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী গ্রেফতার হয় বাড়ি থেকে। এখানে কালীঘাট মোড় পার হলেই ইডি, সিবিআইয়ের গাড়ি স্লো হয়ে যায়। ডায়মন্ড হারবারে বিজেপির প্রার্থী দেখে কি বোঝা যাচ্ছে না যে বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে বোঝাপড়া আছে কিনা। রুটি, রুজির লড়াই শক্তিশালী করতে হবে। এই সেটিং ভাঙতে হবে।
প্রশ্ন: এখানে ISF প্রার্থী না থাকলে ভাঙড়ে সিপিএমের ফায়দা হত?
সৃজন: ISF-এর প্রার্থী না হলে ভালো হত। যা হয়নি তার বিকল্প পথ বের করে নিতে হবে। সেই বিকল্প পথ আমরা বের করা শুরু করেছি। আইএসএফ সঙ্গে থাকলে লড়াই সহজ হত। আমার ধারণা আইএসএফ কর্মী ও সমর্থকরা আমাদের সমর্থন করবেন। তাঁরাও বোঝেন তৃণমূল ও বিজেপির বিপদ। ISF নেতৃত্ব কি করলেন। তাঁদের বিবেচনা করতে অনুরোধ করব। আমরা তবুও সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জিতব।
প্রশ্ন: ভাঙড়ের প্রচারে কি ঘাটতি আছে?
সৃজন: ভাঙড়ে চলুন, কীভাবে প্রচার হচ্ছে দেখবেন। ভাঙড়ের প্রচারে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। যাবদপুর লোকসভা জুড়ে এগোচ্ছি। আমরা কনফিডেন্ট আমরা যাদবপুর জিতব।
প্রশ্ন: আইএসএফের সঙ্গে আসন সমঝোতা না হওয়া, ডায়মন্ড হারবারে দাঁড়ানোর চিন্তা ভাবনা ছড়িয়ে দিয়ে নিজে লড়াইয়ে থাকলেন না নওশাদ। কী বলবেন?
সৃজন: ওদের বিচক্ষণতা, পরিপক্কতা, বিবেচনার প্রশ্ন। আমি পুনর্বিবেচনা করতে আহ্বান ও অনুরোধ জানিয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে নওশাদ ভাইকে অনুরোধ করেছি। যা করছে এতে আমাদের বড় পার্টি, পুরনো পার্টি, আমাদের হয়তো একটু আধটু আঁচর লাগবে। তার বেশি কিছু হবে না। আমরা তাতে মলম লাগিয়ে নেব। কিন্তু আইএসএফ আগামী দিনে থাকবে কিনা সেটাই দেখার। আইএসএফের কর্মী-সমর্থকরা বিপদে পড়বে। আমরা দল ভাঙানোর জন্য বলছি না। নিজেদের স্বার্থে যাদবপুরে বামেদের সমর্থন করতে বলছি।
প্রশ্ন: তৃণমূলের সায়নী ঘোষ না বিজেপির অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়, কে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী?
সৃজন: তাপপ্রবাহ। এটাকেই জুঝতে হবে। আমি আমার রাজনীতির পক্ষে লড়তে নেমেছি। রোটি, কাপড়া ও মকানের পক্ষে লড়তে নমেছি। আমি পানি, বিজলি, সড়কের পক্ষে লড়তে নেমেছি। আমি কারও বিরুদ্ধে লড়তে নামিনি।
প্রশ্ন: শেষমেশ তো ইন্ডিয়া জোটে এরাজ্যে এল না তৃণমূল কংগ্রেস।
সৃজন: কে তৃণমূলের সঙ্গে ইন্ডিয়া জোট করবে। বিজেপি যা যা করেছে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে তৃণমূল সব কটা কাজ করেছে। তৃণমূলের সঙ্গে জোট করার কোনও ব্যাপার নেই।
প্রশ্ন: শূন্য বাম, শূন্য কংগ্রেস। তৃণমূলের কটাক্ষ চলছেই। এবার কতটা কি করতে পারবে?
সৃজন: আমাদের শান্তিতে ঘুম হয় রাতে। অ্যালজোলাম খেয়ে ঘুমাতে হয় না। আমরা ইলেক্টোরাল বন্ডে শূন্য, তিহার জেলেও শূন্য। আমরা প্রেসিডেন্সি বা ভুবনেশ্বরেও শূন্য। জিন্দেগি কি ইয়ে রিৎ হ্যায়, হার কে বাদ জিৎ হ্যায়। জেতার জন্য নেমেছি।
প্রশ্ন: রাজ্যে কোন কোন আসনে জয় বা লড়াইয়ে সামনে থাকবে বামেরা?
সৃজন: ওভাবে বলতে পারি না। কিন্তু যাদবপুর, মুর্শিদাবাদ, দমদম, কৃষ্ণনগর, শ্রীরামপুর, ঝাড়গ্রাম, তমলুক। ডায়মন্ড হারবার দেখো না কি হ্যায়। ওখানে বিজেপি-তৃণমূল মিলিয়ে একটা প্রার্থী। উল্টো দিকে প্রতীকূর রহমান। কংগ্রেস যোগ করলে বহরমপুরে অধীর চৌধুরী, মালদার দুটো সিট, রায়গঞ্জ সব মিলিয়ে ১০-১২টা আসনে বাইনারি ভেঙে যাবে।
প্রশ্ন: তৃণমূল কবে ক্ষমতাচ্যুত হবে বলে মনে করেন?
সৃজন: তৃণমলের ক্ষমতা, দিল্লি থেকে বিজেপি চলে গেলে তৃণমূল এখানে শেষ। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল টিকে আছে দিল্লির ওপর ভরসা করে। BJP ও RSS চায় না বাম বা কংগ্রেস ফিরুক। তার থেকে তৃণমূল থাকুক। তৃণমূলও চায় বামেদের বদলে বিজেপি থাকুক, তাহলে হিন্দু-মুসলমান করতে পারবে। এই দুটো দলকে বিদায় করার জন্য একটা হারলেই আরেকটা হারবে। ২৪-এ তৃণমূল হারলে ২৬-এ গড় গড় করে গড়িয়ে ক্ষমতা থেকে চলে যাবে।
প্রশ্ন: সরাসরি বাইনারি পলিটিক্স চলছে। বাম, কংগ্রেস কতটা ভাঙতে পারবে।
সৃজন: ওই জন্যই তো রুজি, রুটি লড়াইয়ের ওপর জোর দিচ্ছি। রুটি-রুজির গাড়ি এত জোরে চালাব ধর্ম বা জাত নিয়ে ভোট কেউ করতে আসে তাহলে তাঁরা দু'পাশে সরে যেতে বাধ্য হবে। আমাদের ধর্মে কোনও আপত্তি নেই। ধর্মকে ব্যবহার করে দাঙ্গাবাজিতে আপত্তি। কারণ দাঙ্গাবাজরা গরিব হিন্দু-মুসলমান দু'পক্ষের পেটে লাথি মারে। আমরা রুটি, রুজির লড়াই করে এই বাইনারি ভাঙতে চাইছি।
প্রশ্ন: সাগরদিঘী উপনির্বাচনের ফল ফ্যাক্টর হতে পারতো?
সৃজন: পঞ্চায়েত ভোটে বাম-কংগ্রেস লড়াই করে বাইনারি ভেঙে দিয়েছে। বিজেপি ৩৮ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে পঞ্চায়েত ভোটে। কংগ্রেস ও বাম ১০ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে গিয়েছে। এই লোকসভায় বাইনারি আরেকটু ভাঙাটা কাজ, ২০২৬ নির্বাচনে বাইনারি তছনছ করে দিতে হবে। আমাদের সেটাই পরিকল্পনা। ফলত বিজেপি তৃণমূল প্রানান্তকর চেষ্টা করবে। এখন ইডি, সিবিআই, এনআইএ দিয়ে বাইনারি করার চেষ্টা হবে। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে জিনিসের দাম, বেকারত্ব, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, দুর্নীতির কথা বলছি। মানুষ দেখে নিচ্ছে। তৃণমূল বিজেপিকে একই ব্র্যাকেটে রেখে অপছন্দ করছে।
প্রশ্ন: লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিয়ে মহিলা ভোট ব্যাংক ধরে রাখার চেষ্টা হচ্ছে?
সৃজন: ওরা (তৃণমূল) এটা বিজ্ঞাপন করছে। কিন্তু মহিলারা দেখতে পাচ্ছেন এমন লক্ষ্মীর রক্ষা কর্তা যে যেদিন সন্দেশখালি ঘটছে তখন তিনি দিদি নম্বর ওয়ানে গিয়ে নাচানাচি করছেন। বিজেপিও এসটি, এসসি বলছে অথচ পার্লামেন্ট ভবনে উদ্বোধনের দিন রাষ্ট্রপতিকে ডাকল না কেন? তার আগে দলিত রাষ্ট্রপতিকেও ডাকেনি। আসলে এটা ব্রাহ্মণ্যবাদী সংগঠন। তাদের হাতে এসসি, এসটি, ওবিসি, মাইনরিটি কেউই নিরাপদ নয়। আর তৃণমূল আবার এই ভাবে মহিলাদের ভোট ব্যাংক ভাবলে সন্দেশখালি হবে। আর মহিলাদের মানুষ হিসেবে ভাবলে তাঁর আত্মরক্ষা, আত্মমর্যাদা, এই কথাগুলি আমরা বলছি।
প্রশ্ন: সিঙ্গুরে বিধানসভা ভোটে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা কতটা কাজে লাগছে?
সৃজন: সিঙ্গুর ১০০ শতাংশ গ্রামীণ আসন ছিল। যাদবপুর কলেবড়ে বড়। তাছাড়া একদিকে শহর একদিকে মফস্বল মিলিয়ে মিশিয়ে আছে। সিঙ্গুরে শিখেছিলাম আলপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাত তুলে গলার আওয়াজ করে কীভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। সেটা যাদবপুরে অনেক জায়গায় কাজে লেগে যাচ্ছে। সিঙ্গুরের মানুষ ভালবাসা দিয়েছেন, যাবদপুরের মানুষও ভালোবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন।