তৃণমূলের বক্তব্য়, জনপ্রতিনিধিদের মাত্র ০.১ শতাংশ এ ধরনের কার্যকলাপে যুক্ত। বাস্তবে অবশ্য দেখা যাচ্ছে মুর্শিদাবাদ ও মালদায় পঞ্চায়েত সদস্য়দের নামে পোস্টার পড়েছে, উত্তর দিনাজপুরে কাউন্সিলরদের বাড়ির বাইরে চোর খোদাই করে দেওয়া হয়েছে এবং প্রদীপ চক্রবর্তীর বাড়ি লুঠপাট করা হয়েছে।
চণক গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রদীপবাবু প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা (বাংলার বাড়ি) এবং স্বচ্ছ ভারত (নির্মল বাংলা) প্রকল্পে শৌচাগার তৈরির জন্য় টাকা নিয়েছেন।
গ্রামের চন্দনা মাঝি বললেন, "উনি এলাকার ১৮০ জনের কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন বাংলার বাড়ি প্রকল্পে বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার জন্য়। কেউ কেউ বাড়ি বানানোর টাকা পেলেও অনেকেই কিচ্ছু পাননি। নির্মল বাংলা প্রকল্পের শৌচাগার বানানোর জন্য় লোকে ৫০০ টাকা করে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী টাকা ফের দেওয়ার কথা বলার পর আমার ওঁর বাড়িতে যাই। কেউ কেউ পাথর ছুড়লেও কিছু চুরি করা হয়নি।"
আরও পড়ুন, চিটফান্ড তদন্তে বাংলার ২২ জায়গায় সিবিআই তল্লাশি
পার্থবাবুর স্ত্রী রিনা চক্রবর্তী পঞ্চায়েতের উপপ্রধান। তিনি জানালেন তাঁর স্বামী ১১ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছেন কিন্তু এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি। এদিকে পুলিশের কাছে এই গোটা পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য় একেবারে দুঃস্বপ্নের হয়ে উঠেছে।
বীরভূমের পুলিশ সুপার শ্যাম সিং বললেন, "১৭টি মামলায় অন্তত ৮১ জন গ্রেফতার হয়েছে। এরা সকলেই বিক্ষোভকারী এবং এদের জন্য়ই জেলায় সমস্য়ার সৃষ্টি হচ্ছে।" রাজ্য়ের আইজি (আইন শৃঙ্খলা) জ্ঞানবন্ত সিং এ ব্য়াপারে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কাছে কোনও মন্তব্য় করতে চাননি। বর্ধমানের এক সিনিয়র পুলিশ অফিসার বলেন, "আমরা সমস্ত পদক্ষেপ করছি কিন্তু এলাকায় উত্তেজনা রয়েছে। আমরা চাই না উত্তেজনা বাড়ুক।"
এক প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মতে সরকারি চাকরি এবং সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে কাটমানি নতুন কিছু নয়। তবে তাঁদের মতে এই সিস্টেম ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর এবং বেশ কিছু উন্নয়নমূলক প্রকল্প শুরু হওয়ার পর বৃদ্ধি পেয়েছে।
আরও পড়ুন, স্বস্তিতে রাজীব কুমার, বাড়ল রক্ষাকবচের মেয়াদ
প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্য়ক্ষ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ এ পরিস্থিতিকে 'কাটমানির প্রাতিষ্ঠনিকীকরণের' প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, "বাম ফ্রন্ট শাসনের সময়েও এ জিনিস ছিল। আজ শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় বদমাশদের কাছে সমস্ত কাজের জন্য় কাটমানি দিতে হয়।"
রেলের আইজিপি পশ্চিমবঙ্গ হিসেবে অবসরগ্রহণ করেছেন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার পঙ্কজ দত্ত। তিনি বললেন, "আমার মনে হয় না মমতা বুঝেছিলেন সমস্য়া এক গভীরে। বেশিরভাগ জায়গাতে লোকজন টাকা ফেরত পাচ্ছে। এর ফলে ওঁর নিজের ভাবমূর্তি উন্নত হচ্ছে, কিন্তু দাম দিতে হচ্ছে দলের কর্মীদের।"
প্রদীপ চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে জঙ্গল গ্রামে, গদাধর খাঁয়ের স্ত্রী চম্পা খাঁয়ের বলছিলেন তাঁর পরিবার আতঙ্কের মধ্য়ে দিন কাটাচ্ছে। দলের উপর তলা থেকে কেউ কিছু বলছে না।
৪৫ বছরের চম্পা খান বললেন, "চারদিন আগে গ্রামের লোক এসে টাকা চায়। ওরা গোটা বাড়ি তছনছ করে এবং আমাদের পাথর ছোড়ে। আমার স্বামী ও দুই ছেলে বাড়ি ছেলে চলে যাওয়ার পর রয়েছি আমি আর ৮৫ বছরের শাশুড়ি বাড়িতে রয়েছি। জানি না কী হবে! আমরা বাজারেও যেতে পারি না। বাইে বেরোলেই লোকে চিৎকার করে, টাকা চায়।"
"মুখ্য়মন্ত্রীর সবার সামনে বলার কী দরকার ছিল?" প্রশ্ন তাঁর।
১২ কিলোমিটার দূরের জলপার গ্রামের তৃণমূল নেতা ভগীরথ কৈবর্তও বাড়ি নেই। তাঁর আত্মীয়রা জানালেন গত ২৩ জুন এলাকার বাসিন্দাদের ডাকা শুনানিতে তিনি কাটমানি ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আরও পড়ুন, ফেক নিউজে রাশ টানতে আইন প্রণয়নের দাবি রাজ্যসভায়
ভগীরথের মা ভক্তি বললেন, "ও বৌ বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। যদি মুখ্য়মন্ত্রী কাট মানি নিয়ে বললেনই, সবার সামনে বলার কী দরকার ছিল! উনি বন্ধ ঘরে ডেকে সবাইকে সাবধান করে দিতে পারতেন। পার্টির কে কাটমানি নেয়নি? এখন আমাদের জীবন নরক হয়ে গেছে।" গ্রামে ভগীরথদের বাড়িটি আলাদা করে চেনা যায়। তিন তলা বাড়ির ওপর তলায় নির্মাণ কাজ চলছে।
বর্ধমান শহরের ৫৫ কিলোমিটার দূরে অনন্ত পালের স্ত্রী পম্পা তৃণমূলের প্রাক্তন কাউন্সিলর। তাঁর অভিযোগ, বিজেপির লোকজন এখন সমস্ত প্রকল্প নিয়ে কাউন্সিলর এবং স্থানীয় নেতাদের প্রশ্ন করছে।
অনন্ত পাল বললেন, "২৩ জুনের রাতে এবং ২৪ জুন বিকেলে আমাকে বিজেপি সমর্থকরা মারধর করে। তারা আমাকে এলাকার সৌন্দর্যায়নের খরচ নিয়ে প্রশ্ন করে এবং শোনা কথার উপর ভিত্তি করে বলে আমি সে টাকা নিজের পকেটে ভরেছি এবং তা দিয়ে পুরনো একটা গাড়ি কিনেছি।"
বীরভূমের সিউড়িতে তৃণমূলের বুথ কমিটির প্রধান ত্রিলোচন মুখোপাধ্য়ায় ২৬ জুন ২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছেন বলে দাবি করলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এলাকার বাসিন্দা সোমনাথ মাল বললেন, "আমাদের চাপে পড়ে উনি টাকা ফেরত দিতে বাধ্য় হয়েছেন।" এব্য়াপারে ত্রিলোচন মুখোপাধ্য়ায়ের বক্তব্য় জানা যায়নি। টাকা ফেরত দেওয়ার পরেই তিনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন।
Read the Story in English