২৩ জুনের রাত। পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট তহশিলের তৃণমূল কংগ্রেস ব্লক সম্পাদক প্রদীপ চক্রবর্তী, তাঁর স্ত্রী রিনা, তাঁর ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতি বাড়ি ছেড়ে পালালেন। আশ্রয় নিলেন দলের বানানো এক বাড়ির ভেতরের একটি ঘরে। "এটাই এখন আমার বাড়ি। দলের উপর তলা থেকে কী নির্দেশ আছে তার জন্য় আমরা অপেক্ষা করছি। আমার গোটা রাজনৈতিক জীবনে আমি এরকম দেখিনি, দাবানলের মত ব্য়াপারটা ছড়িয়ে পড়ছে।"
৫৭ বছর বয়সী এই তৃণমূল নেতা, দলের আরও অনেক ছোট নেতাদের মতই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গ্রামবাসীরা তাঁদের তাড়া করছেন কাট মানি ফেরতের জন্য়। কাট মানি অর্থাৎ বেআইনি কমিশন। অভিযোগ এই নেতারা কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য় এই কাটমানি নিয়েছেন।
আরও পড়ুন, ‘কালীঘাটে ১৩টি ফ্ল্যাট, পুরী-গোয়াতে হোটেল, তৃণমূল সুপ্রিমোকে উত্তর দিতে হবে’
প্রদীপ চক্রবর্তীর বাড়ি চানক গ্রামে। তিনি বলছিলেন, "সেদিন সন্ধেয় গ্রামবাসীরা আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে ইট ছুড়তে শুরু করে।" পার্টির ওই বাড়িতে এখন তাঁর প্রতিবেশী সমীরণ মাঝি, ওই গ্রামেরই তৃণমূলের বুথ স্তরের নেতা। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে তিনিও পালিয়ে এসেছেন ২৪ জুনে।
১৮ জুন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় পার্টি নেতাদের বলেন কাটমানি নেওয়ার অভ্য়েস ত্য়াগ করতে এবং এতদিন ধরে নেওয়া কাট মানি ফিরিয়ে দিতে।
বর্ধমান, বীরভূম, হুগলি, মালদা, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার এবং উত্তর দিনাজপুরের মত জেলায় তৃণমূলের নিচের স্তরের নেতাদের কাছে সেটাই শেষের শুরু। অনেককেই কাট মানি ফেরত দিতে হয়েছে, বা লিখে দিতে হয়েছে যে শিগগিরই তাঁরা টাকা ফেরত দেবেন। কেউ কেউ স্রেফ পালিয়ে বেঁচেছেন।
আরও পড়ুন, সারদাকাণ্ডে শুভাপ্রসন্ন-শিবাজী পাঁজাকে তলব সিবিআইয়ের
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের তরফ থেকে বর্ধমান, বীরভূম ও হুগলির ১২টি গ্রামে যাওয়া হয়েছিল, যেখানে কাটমানি নিয়ে সংকট সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করেছে। দেখা গেছে, কাট মানি নতুন কিছু নয়, এ অভ্য়েস চলছে সেই বামফ্রন্টের সময় থেকেই। বছরের পর বছর ধরে চলা এ অভ্য়াস ক্রমশ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য় কাটমানির হার নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই কালেকশনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে বেশ বিপাকে পড়েছে তৃণমূল। সে কারণেই তৃণমূল সরকারকে এ ব্য়াপারে নালিশ জানানোর জন্য় বিশেষ সেল খুলতে হয়েছে এবং ১০ জুন থেকে ১৫০০ র বেশি অভিযোগ সেখানে জমা পড়েছে। এসবই বিজেপির হাত থেকে বাঁচতে, যাতে এ সম্পর্কিত ক্ষোভের সুযোগ না নিতে পারে তারা।
এর ফলে স্থানীয় টিএমসি নেতা এবং তাঁদের পরিবাররা কার্যত আজ পথে বসেছেন। মঙ্গলকোটের জলঙ্গি গ্রামের গদাধর খাঁ স্ত্রী ও দুই পুত্রকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গদাধরের স্ত্রী চম্পা বলছিলেন, "আপনার কী মনে হয়! আমার স্বামী টাকা রেখে দিয়েছে! সবাই জানে এটা কীরকম ভাবে চলে। পার্টির উপরতলায় টাকা দিতে হয়। বছরের পর বছর ধরে এ জিনিস চলছে। কিন্তু কেউ দলের বড় নেতাদের দরজায় খটখট করছে না।"
বর্ধমানের বড় নেতা তথা ক্ষুদ্র, মাঝারি ও অতি ক্ষুদ্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথ এ কথা জোরের সঙ্গে অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, "আমি এ ব্য়াপারে কিছু বলব না। কারও অভিযোগের ভিত্তিতে আপনার যা মনে হয় লিখুন। আপনারা আসল ছবি দেখাচ্ছেন না। বিজেপির কিছু লোক মিলে আমাদের নেতাদের হেনস্থা করছে।"