Advertisment

বেহাত হচ্ছে জমি, অনাদরে বিভূতিভূষণের ভিটে, বাঁচানোর অদম্য লড়াই শিক্ষকের

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে থেকে গায়েব হচ্ছে মাটি। অনাদরে রয়েছে সাহিত্যিকের বসতবাড়িটিও।

author-image
Joyprakash Das
New Update
demands preservation of Bibhutibhushan banerjee's ancestral home

বাঁদিকে, বসতবাড়িতে কালজয়ী সাহিত্যিকের মূর্তি। ছবির ডানদিকে, পৈতৃক ভিটে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টি শুধু বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেনি এখনও তাঁর লেখনির ওপর ভরসা করে টলিউড। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিত রায় বিভূতিভূষণের প্রথম উপন্যাস পথের পাঁচালি চলচ্চিত্রে রূপায়ণ করে একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। সম্প্রতি অনীক দত্ত পরিচালিত অপরাজিত-র নন্দন প্রেক্ষাগৃহ না পাওয়া নিয়েও বিতর্ক দেখা দেয়। তাঁর লেখার ওপর ভিত্তি করেই পথের পাঁচালি, অপরাজিত, আদর্শ হিন্দু হোটেল, নিশি পদ্ম, অশনি সংকেত, আলো, চাঁদের পাহাড়-সহ একাধিক চলচ্চিত্র বক্স অফিসে হিট হয়েছে। অথচ উত্তর ২৪ পরগনার বারাকপুর-শ্রীপল্লীতে বিভূতিভূষণের পৈতৃক ভিটের রক্ষণাবেক্ষণে কারও কোনও হেলদোল নেই। অল্পবিস্তর সংরক্ষণ করলেও প্রায় অনাদরে পড়ে রয়েছে বিভূতিভূষণের বসতবাটিও।

Advertisment

বনগাঁ ও রানাঘাট রেল শাখার গোপালনগর স্টেশনে নেমে টোটোতে মিনিট দশেকের পথ পেরোলেই পৌঁছনো যাবে প্রখ্যাত বাংলা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটেয়। সড়ক পথে সরাসরি বনগাঁ থেকেও যাওয়া যায় বারাকপুর। সাহিত্যিকের বসতবাটিতে গিয়ে দেখা গেল, ইতিউতি গাছের পাতা পড়ে রয়েছে উঠোনে। প্রধান ফটক বন্ধ নয়, তবে ঘরের দরজা তালাবন্ধ। কাঁটাতার দিয়ে বাউন্ডারি দেওয়া। পর্যটকদের বসার জায়গা নেই, নেই কোনও কেয়ার-টেকার।

publive-image
এটাই কালজয়ী সাহিত্যিকের ভিটেয় ঢোকার গেট।

আগে এই জায়গাটা পরিচিত ছিল চালকি-বারাকপুর নামে, এখন পরিচিতি বারাকপুর-শ্রীপল্লী নামে। খোঁজ করতেই জানা গেল, স্থানীয় বাসিন্দা শিক্ষক সমরেশ মুখোপাধ্যায়ের কাছে ঘরের চাবি থাকে। তেমন কেউ এসে খোঁজ করলে তিনিই ঘরের তালা খোলেন। তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন। জীবনের শেষ দশ বছর বারাকপুরের এই বাড়িতেই কাটিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠাকুরদা তারিনিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটে এখন মাটির ঢিবি। যদিও সেই মাটির ঢিবিও লোকে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। জমি-জায়গাও বেহাত হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। সাহিত্যিক সমরেশ মুখোপাধ্যায় বলেন, 'এই ভিটেতে বাস করেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভূতিভূষণের শৈশব এই ভিটেতে কেটেছিল। এখনকার বাড়িটা ১৯৩৮ সালে সই-মার কাছে কিনেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ওই বাড়িতে আমৃত্যু ছিলেন বিভূতিভূষণ।'

publive-image
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটের জমি থেকে প্রায়ই মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে।

প্রখ্যাত সাহিত্যিকের পৈতৃক ভিটের সংরক্ষণের দাবি করেছেন সমরেশ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, 'এই ভিটেটা অবহেলিত হয়ে পড়ে রয়েছে। ভিটের মাটিও কেটে নিচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা চাইছি এখানে বিভূতিভূষণ সংগ্রহশালা তৈরি হোক। সে ব্যাপারে আলাচনা চলছে। আশা করছি আলোচনা ফলপ্রসু হবে। আমরা চেষ্টা করছি বিভূতিভূষণের তীর্থস্থান রক্ষা করার। আমাদের প্রচেষ্টা রয়েছে সংরক্ষণ করার। এব্যাপারে তাঁর পরিবারের সঙ্গে ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আমরা আলোচনা করছি।'

বিভূতিভূষণের কর্মজীবন এখানে কেটেছে দ্বিতীয় বিবাহের পর ১৯৪০ থেকে ১৯৫০-এর অক্টোবর পর্যন্ত। তিনি সবসময় এখানে থাকতেন না। পুজোর ছুটি বা গরমের ছুটিতে ঘাটশিলার বাড়িতে চলে যেতেন। ১৯৫০-এর ১ নভেম্বর ঘাটশিলাতে তাঁর দেহান্তর হয়।

বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাই ধরা পড়ে সাহিত্যিকের লেখায়। পথের পাঁচালি শুধু বঙ্গ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেনি, বাংলাকে গোটা বিশ্বে পরিচিত করেছে। উজ্জ্বল করেছে বাংলার মুখ। বিখ্যাত হয়েছেন পরিচালক সত্যজিত রায়ও। সমরেশবাবুর কথায়, 'পথের পাঁচালিতে তাঁর ছোটবেলার বর্ণনা আছে এবং তাঁর পরিবারের কথা আছে। বিভূতিভূষণের ডায়েরি পড়লেও বোঝা যায়, এই গ্রামকে ভুলতে পারেননি। বিভূতিভূষণের লেখাতে ও স্বীকারোক্তিতে দেখা যায় পথের পাঁচালির পটভূমি এই গ্রামকে কেন্দ্র করেই। এছাড়া ইছামতীর ধারের এই গ্রাম বা মানুষজনের কথাও আছে। তাঁর বিভিন্ন ছোট গল্পে এই গ্রামের কথা উঠে এসেছে।'

publive-image

এখনও পর্যন্ত পৈতৃক ভিটে বা সাহিত্যেকের বসতবাড়ি সেভাবে সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ল না। স্থানীয় বাসিন্দা অপূর্ব মুখোপাধ্যায় বলেন, 'স্থানীয় পঞ্চায়েত, ক্লাব ও গ্রামবাসী মিলে কাজকর্ম চলে। সাহিত্যবাসর চলে। যাঁরা এখানে আসেন তাঁদের বসার জায়গা পর্যন্ত নেই। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসেন। একটা উদাসীনতা আছে। পরিবার থেকে জায়গাটা না দেওয়ায় রক্ষণাবেক্ষণের একটা সমস্যা আছে।'

সমরেশ মুখোপাধ্যায় বলেন, 'সব থেকে বড় সমস্যা এই বসতবাটি, সম্পত্তি রক্ষা করা। যত দিন না প্রকৃত কমিটি বা সংগঠন হচ্ছে ততদিন এটা মিটবে না। এখন আমি দেখছি পরে অন্য কেউ দেখবেন। তবে এটা সংরক্ষণ করা দরকার। বিভূতিভূষণের সম্পত্তি ও স্মৃতিবিজরিত জায়গা সংরক্ষণ, অডিটোরিয়াম, তাঁর উপর একটি মিউজিয়াম, সংগ্রহশালা, লাইব্রেরি, বিভূতি অ্যাকেডেমি করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।'

preserve West Bengal
Advertisment