Advertisment

ওঁরা নির্ভয়, কিন্তু গণতন্ত্র কি ভয় পাচ্ছে?

“যাঁরা জাতীয়তাবাদের নামে ঘেন্নার চাষ করছেন, তাঁরা আমাদের দেশের সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিলে কীসের গণতন্ত্র!"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
democratic voice attacked but not afraid

মানবাধিকার সংগঠনের যুদ্ধবিরোধী মিছিলে জাতীয় পতাকা নিয়ে হামলা (ফাইল)

কেউ বলেছিলেন, যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়, প্রয়োজন আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানসূত্র খুঁজে পাওয়া। কারও মত ছিল, জঙ্গী হামলায় নিহত সেনা জওয়ানদের পাশাপাশি গত কয়েক দশকে নিহত কাশ্মীরি যুবকদের কথাও ভেবে দেখা জরুরি। কেউ খুঁজতে চেয়েছিলেন কাশ্মীরের মানুষের মনস্তত্ত্ব। জানতে চেয়েছিলেন কেন তাঁরা মৃত্যুর সম্ভাবনা মাথায় নিয়েও পেলেট বা গুলির সামনে দাঁড়িয়ে পাথর ছোঁড়েন সেনাবাহিনীর দিকে! তরতাজা কিশোর বা যুবক কোন অমোঘ টানে খেলার মাঠ বা স্কুলের ক্লাসরুম ছেড়ে হাতে তুলে নেন অত্যাধুনিক অস্ত্র! কেউ পা মিলিয়েছিলেন যুদ্ধবিরোধী শান্তি মিছিলে। বলতে চেষ্টা করেছিলেন মৃত্যুর জবাব কখনও মৃত্যু হতে পারে না। এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তির পরিবেশ নির্মাণ করতে পারে একমাত্র কথপোকথন, নিরন্তর আলাপ আলোচনা, ভাব বিনিময়। কেউ সোস্যাল মিডিয়ায় লিখেছিলেন, যুদ্ধে লাভবান হন কেবলমাত্র  দুই দেশের রাজনীতির কারবারিরা, গরীব-নিম্মবিত্ত ঘরের সন্তান সেনাকর্মীদের লাশের উপরে তৈরি হয় মুনাফার পাহাড়। যুদ্ধের উন্মাদনায় বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়া দেশনেতাদের সৌজন্যে আমজনতার বরাতে জোটে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারির মতো হাজার সমস্যা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো জাঁকিয়ে বসে দুর্নীতি। কার্গিল যুদ্ধের সময়ের কফিন কেলেঙ্কারির স্মৃতি তো এখনও দগদগে। কেউ কেউ ফেসবুক বা টুইটারে মতপ্রকাশ করেছিলেন, এই ভোগান্তির কোনও সীমান্ত নেই। করাচি হোক বা কলকাতা, রাওলপিন্ডি হোক বা রাজস্থান, লাহোর অথবা লখনৌ- যুদ্ধের লাথি সবচেয়ে জোরে আঘাত করে আমজনতার পেটে।

এই ছিল তাঁদের অপরাধ। এই কথাগুলো বলার জন্যেই কাউকে ধর্মতলার মেড়ে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে, কারও বাড়িতে চড়াও হয়েছেন স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকেরা। যুদ্ধবিরোধী মিছিল থেকে টেনে বের করে পেটানো হয়েছে কাউকে। কারও বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়েছে, বলা হয়েছে ধর্ষণ করে ভেঙে দেওয়া হবে যৌনাঙ্গের হাড়। কারও একরত্তি সন্তানের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে নব্য জাতীয়তাবাদীরা লিখেছেন খুন করে পুঁতে দেওয়া হবে শিশুটিকে।

Advertisment

ওঁরা কিন্তু ভয় পাননি। বারাসতের সঞ্চারী, যাদবপুরের সুদেষ্ণা, মুর্শিদাবাদের শাহ রেজা আলম, বাগবাজারের মধুবন্তী, ব্যারাকপুরের অমিতাভরা বলছেন, এই দেশ তাঁদেরও। যাঁরা তাঁদের আক্রমণ করছেন, তাঁরা আসলে ভারতের সংবিধান এবং গণতন্ত্রকেই অপমান করছেন। তাই কলম চলবে। ইতিমধ্যেই প্রশাসনের দারস্থ হয়েছেন আক্রান্তদের একাংশ। পাশাপাশি হিংসা, দ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টির ‘অপচেষ্টা’র বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে পথে নামারও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন, চিত্রদীপের নিগ্রহ: ঠিক কাজ নয়, একমত বিজেপি-বজরং নেতারা

ধর্ষণ ও খুনের হুমকি সঞ্চারীর কাছে নতুন কিছু নয়। রবিবার তিনি বলেন, “এর আগেও একাধিকবার ফেসবুকে নিজের মতপ্রকাশের অপরাধে আক্রান্ত হয়েছি। খুন, ধর্ষণের হুমকি প্রায়শই পায়। কিন্তু এবার যা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। পুলওয়ামায় জঙ্গী হামলার পর আমি লিখেছিলাম, সেনাবাহিনীর মৃত্যু অত্যন্ত যন্ত্রণার। কিন্তু দশকের পর দশক যে কাশ্মীরীরা আক্রান্ত হয়েছেন, পেলেটের আঘাতে দৃষ্টিশক্তি খুইয়েছেন, তাঁদের কথাও আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। নাহলে আমরা কোনও সমাধানে পৌঁছতে পারব না। মৃত্যুমিছিল অব্যাহত থাকবে।  আমি বলতে চাই কাশ্মীর উপত্যকা যদি আমাদের হয়, তাহলে সেখানকার বাসিন্দাদেরও আপন করে নিতে হবে। তাঁদের যন্ত্রণা অনুভব করতে হবে।” তাঁর কথায়, “এখনও পর্যন্ত প্রায় দু'হাজার হুমকি মেসেজ পেয়েছি। কেউ বলছেন গণধর্ষণ করা হবে, কেউ আমার সন্তানকে খুন করতে চাইছেন। পুলিশের কাছে গিয়েছি, কিন্তু সদর্থক ফল পাইনি। আমার মতে প্রশাসন যাই করুক, আমরা যারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, আমাদের রাস্তায় নামা জরুরি। সোমবার, ২৫ তারিখ আলিপুরে জমায়েত করব আমরা।”

কলেজপড়ুয়া শাহ রেজা আলম ‘প্যাডম্যান’ নামে পরিচিত। অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (আইসা) কর্মী, কেমিস্ট্রি অনার্সের ছাত্র রেজা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রত্যন্ত গ্রামের দুঃস্থ মহিলাদের কাছে প্রতি মাসে স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দেন। তাঁদের উদ্যোগের নাম ‘পদক্ষেপ।’ কোনও কর্পোরেট ফান্ডিং নেই, রেজাকে সাহায্য করেন তাঁর বন্ধুরা, পরিচিত মানুষজন। মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা এই যুবক এখন কলকাতার একটি কলেজের পড়ুয়া। জানবাজার এলাকায় একটি যুদ্ধবিরোধী মিছিলে হাঁটার সময় তাঁর উপর চড়াও হন একদল স্বঘোষিত দেশপ্রেমিক। হাতে জাতীয় পতাকা। মুখে ভারত মাতা কি জয় এবং অশ্লীল গালিগালাজ। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন রেজা।

Advertisment

আরও পড়ুন, জাতীয় পতাকা নিয়ে হামলা শহরের যুদ্ধবিরোধী মিছিলে

এদিন তিনি বলেন, “যাঁরা জাতীয়তাবাদের নামে ঘেন্নার চাষ করছেন, তাঁরা আমাদের দেশের সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিলে কীসের গণতন্ত্র! আমি প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের সঙ্গে  কাজ করি। তাঁরা কিন্তু দেশকে ঘৃণা তৈরির মেশিন হিসাবে দেখেন না।” রেজার বক্তব্যের সঙ্গে সহমত বালির বাসিন্দা, আইসার রাজ্য নেতা নীলাশিস বসু। তিনি বলেন, “জনগণের শোককে ব্যবহার করে যুদ্ধের জিগির তুলছে কিছু কায়েমি স্বার্থবাজ। কিন্তু তারা সফল হবে না। ইতিমধ্যেই ভিন্নস্বর প্রবল হয়ে উঠেছে।”

মার খেয়েছেন জুট মিল এলাকার সমাজকর্মী মধ্য চল্লিশের অমিতাভ রায়ও। এলাকায় যুদ্ধ উন্মাদনার বিরুদ্ধে লিফলেট বিলি করছিলেন তিনি। তাতে লেখা ছিল আলাপ আলোচনাই একমাত্র সমাধান। কারণ দুটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র যুদ্ধে জড়ালে তার পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে। অমিতাভ বলেন, “আমরা তিনজন ছিলাম। একটি কেন্দ্রীয় দলের দফতর থেকে একদল লোক বেরিয়ে আমাদের উপর চড়াও হল। লিফলেটগুলো ছিঁড়ে দিল, তারপর শুরু হল মার। রাতে বাড়িতে গিয়ে গালিগালাজ করল। কিন্তু আমি আমার বক্তব্য থেকে সরব না। কারণ আমি জানি যে ভুল কিছু করিনি।”

প্রতিবাদীরা ভয় পাচ্ছেন না। কিন্তু ভয় দেখানোর চেষ্টা তো থামছে না। এই আস্ফালনে কি ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে গণতন্ত্রের পরিসর? প্রশ্নটা থাকছেই।

Advertisment