চিকিৎসা জাদুঘর। এই বাংলায় এমন জাদুঘর প্রথম বলেই মনে করছেন, এর স্রষ্টা প্রবীণ এক চিকিৎসক। দেশেও এমন জাদুঘরের কথা খুব একটা শোনা যায় না। চিকিৎসা ক্ষেত্রের প্রতিটি বিভাগে যেসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার হয়, সেই সব যন্ত্রপাতি থাকছে এই জাদুঘরে। পাশাপাশি থাকছে সেই সব যন্ত্রপাতির কী কাজ, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ বাংলা ও ইংরেজিতে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত নানা উপদেশনামাও থাকছে এই জাদুঘরে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অবদানকারীদের ছবিও স্থান পেয়েছে জয়নগরের জাদুঘরটিতে।
কলকাতা থেকে প্রায় ১১৫ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের প্রত্যন্ত গ্রাম জয়নগরে এই জাদুঘরের উদ্যোক্তা বিশিষ্ট গাইনোকলজিষ্ট ডা. বিমান ঘোষ। দীর্ঘ বছর ইংল্যান্ড-সহ নানা দেশে চিকিৎসা করেছেন, সেই অভিজ্ঞতার কথাও মাথায় রেখেছেন চিকিৎসা জাদুঘর নির্মাণ কৌশলে। ভবনের আদলেও ইংল্যান্ডের ছোঁয়া রয়েছে। আগামী ১৪ জানুয়ারি সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে এই জাদুঘর।
চিকিৎসা জাদুঘরের অন্দরমহল। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
চিকিৎসা জাদুঘর নির্মাণের কথা কীভাবে মাথায় এল? ডা. বিমান ঘোষ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বলেন, 'আমি যখন চিকিৎসা করছি তখন আমার শিক্ষক ডা. বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী আমাকে বলেন, তুমি কাজ জানো। কিন্তু যন্ত্রপাতি না-থাকলে কাজ করবে কী করে? তখন স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে ইমপোর্ট পারমিট করেছিলাম। তখন এত ফ্রি মার্কেট ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে ফ্রি মার্কেট হল। নতুন হাসপাতাল, নার্সিংহোম হল। তারা যন্ত্রপাতি কিনল। যখন সেখানে অপারেশন করতে যাচ্ছি তখন তো ওদের যন্ত্রপাতি থাকায় আমারগুলি আর কাজে লাগছে না। তখনই ভেবেছিলাম আমি যখন অবসর নেব তখন এই যন্ত্রপাতি নিয়ে কী করব? বরং, গ্রামের লোকের চিকিৎসার ক্ষেত্রে শিক্ষার ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। আমি দেখলাম আমার তো সীমিত যন্ত্রপাতি। তাই আমি অন্যদের কাছ থেকেও যন্ত্রপাতি জোগাড় করেছি।'
তাঁর নানা সংগ্রহের মাঝে চিকিৎসক বিমান ঘোষ। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
মূলত কাদের জন্য এই জাদুঘর? জবাবে ডা. বিমান ঘোষ বলেন, 'গ্রামীণ চিকিৎসকরাই মূলত গ্রাম-গঞ্জে চিকিৎসা করেন। আমি দেখেছি তাঁদের অভিজ্ঞতাও আছে। এই জাদুঘরে এলে তাঁরা আইডিয়া পাবেন। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, ল্যাপারোস্কোপি-সহ নানা বিষয় এখানে তুলে ধরা হয়েছে। মানবদেহের ভিসেরা রাখা-সহ অন্যান্য পরিকল্পনাও আছে। থাকছে, নানা চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি। বেশ কিছু রেফারেন্স বই আছে। একইসঙ্গে স্কুলের ছাত্ররা এখানে এলে উৎসাহিত হবে। চিকিৎসক হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে এই জাদুঘর। তাছাড়া আশপাশের গ্রাম থেকেও এখানে আসতে পারে ছাত্র-ছাত্রীরা। মেডিক্যাল ছাত্র-ছাত্রীরা এটা দেখে একটা ধারণা নিতে পারবে, কোন বিভাগে তারা যাবে।' এই জাদুঘর লাগোয়া জয়নগর প্রাথমিক বিদ্যালয়। তার পাশেই রয়েছে হাইস্কুল, জয়নগর ঠাকুরদাস বিদ্যাভবন।
বিশিষ্ট চিকিৎসক বিমান ঘোষ। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
এই চিকিৎসা জাদুঘরে নিজের যন্ত্রপাতি যেমন রয়েছে, পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতাল ও বন্ধু চিকিৎসকদের কাছ থেকেও চেয়ে-চিন্তে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেছেন ডা. বিমান ঘোষ। তিনি বলেন, 'এখানে সার্জারি, মেডিসিন, আই, ইএনটি, গাইনোকোলজি, কার্ডিও সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারি-সহ নানা বিষয়ের প্রায় ২০০ ধরনের যন্ত্রপাতি রয়েছে। আমি চাই এই জাদুঘরের কথা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ুক। লোকে জানুক। অনেকে বলছেন শহরে কেন নয়? অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ লন্ডন শহরের মধ্যে নয়। এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নগর হয়েছে। লন্ডন শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে। আমিও মনে করি, গ্রামকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। তাকে কেন্দ্র করে জনপদ তৈরি হোক। আমার বন্ধু-বান্ধবরা এটা শুনে এক্সাইটেড। তাঁরা সাহায্য করার চেষ্টা করেছে। ৫০-৬০ জন চিকিৎসক আসবেন উদ্বোধনের দিন।'
চিকিৎসা জাদুঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে চিকিৎসক বিমান ঘোষ। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
১৯৭৮-এর বন্যায় পাশের পাঠাগার সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেটাও নতুন ভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। বিমানবাবু বলেন, 'এই গ্রামের ছেলে হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়ের উন্নয়নের পাশে থাকার চেষ্টা করি।' পাশের ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত জয়নগর প্রাথমিক স্কুলে পড়াশুনা করেছেন ডা. বিমান ঘোষ। বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন তিনি। নিয়মিত গ্রামে যোগাযোগ রাখেন ৭৬ বছরের এই গাইনোকলজিষ্ট। স্ত্রী এষা ঘোষ এনাস্থেসিস্ট । জাদুঘর নির্মাণে তাঁর অনুপ্রেরণার কথাও বলেছেন ডা. বিমান ঘোষ। ভবন নির্মাণে তাঁর লন্ডনে থাকারও ছাপ স্পষ্ট। বিশিষ্ট এই চিকিৎসকের আশা, জয়নগর গ্রামটা যেন শিক্ষার একটা তীর্থক্ষেত্র হয়ে ওঠে।