Advertisment

আমরা গণতন্ত্রের পুতুল-পুতুল খেলছি, ক্ষমতা আসলে ২৯৪ ভূমিশ্বরের হাতেই: ডাঃ কুণাল সরকার

রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে কী মত বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের?

author-image
Joyprakash Das
New Update
dr kunal sarkar interview on bengal politics, আমরা গণতন্ত্রের পুতুল খেলছি, ক্ষমতা আসলে ২৯৪ ভূমিশ্বরের হাতেই: ডাঃ কুণাল সরকার

ডাঃ কুণাল সরকার ছবি-শশী ঘোষ

কোভিড ১৯ বদলে দিয়েছে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা। করোনা আবহে লকডাউনে ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকেরা আবারও ফিরে গিয়েছেন ভিনরাজ্যের কর্মস্থলে। তবে মাইলের পর মাইল হাঁটা পরিযায়ী শ্রমিকরা পায়ের ফোসকা কখনও কি ভুলতে পারবেন? দেশের গণতন্ত্র নিয়েই বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ কুণাল সরকার। পড়ুন ডাঃ সরকারের সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব।

Advertisment

প্রশ্ন- লকডাউনে কি একটা অংশ বড় ফায়দা লুটেছে?

ডাঃ কুণাল সরকার- ফায়দা লোটেনি তা নয়। পলিটিক্যাল বেনিফিট ফর কোভিড। গণতন্ত্র একেবারে কৃত্রিম বলে মনে করি। আমরা সবাই গণতন্ত্র চাই, কিন্তু কেউ সেটাকে মানি না। গণতন্ত্র চাইলেও আমরা অগণতান্ত্রিক চরিত্র। কিন্তু আমরা ডেমোক্রেসি ডোমোক্রেসি পুতুল খেলি। প্রতিটি দেশের সরকার কমবেশি তুমিও প্রধানমন্ত্রী হলে চাইতে প্রভু্ত্ব বজায় রাখতে। মানুষের জিঘাংসা বা লোভ কোভিডে চরিতার্থ করেছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

প্রশ্ন- লকডাউনে কতটা ক্ষতি হয়েছে?

ডাঃ কুণাল সরকার- লকডাউন কতটা ব্যর্থ তা আমি জানি। প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। বিশ্বের ২০০ দেশের মধ্যে একমাত্র সুইডেন লকডাউন না করার পলিসি নিয়েছিল। লকডাউন কোনও কাজের নয়। লকডাউনে ধাক্কাটা একটু কমবে, তুমি যখন চেপ্টে দেবে ওয়েবটাকে টাইমে আরও বেড়ে যাবে। একমাত্র লকডাউন করা যেত যেখানে হাসপাতালের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই সেখানে। সুইডেন বলেছিল স্কুল, কলেজ, দোকানপাট, কারখানা যতটা পারব খোলা রাখবে। তাঁরা কেয়ারফুল ছিল বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষদের প্রোটেক্ট করার জন্য। সুইডেন ও অন্যদের ডেথ রেটের পার্থক্য নেই। সুইডেন অর্থনৈতিক দিক থেকে ভাল জায়গায় রয়েছে, অন্যদিকে বাকিদের হাঁটু ভেঙে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন- ‘এখন কোভিড আছে আমাদের মনে’, সোজাসাপটা ডাঃ কুণাল সরকার

প্রশ্ন- আমাদের কোভিড পরবর্তী অর্থনীতির কেমন অবস্থা….

ডাঃ কুণাল সরকার- এখনও ভারত খানিকটা জলের ওপর নাকটা দিয়ে রয়েছে। আমরা কোভিড পরবর্তী অর্থনীতির দিক থেকে অন্যদের থেকে ভাল জায়গায় আছি। প্রধান কারণ হল, প্রচুর থালা-বাটি বাজিয়েছি। কিছু সস্তার চালডাল দিয়েছে, অসংঘটিত শ্রমিকদের প্রোটেক্ট করিনি, তাঁদের মাইলের পর মাইল হাঁটিয়েছি। আমাদের ৬০ শতাংশ ভ্যাকসিনেশন পকেটের পয়সা দিয়ে নিতে হয়েছে। আমাদের দেশে আনএমপ্লয়েড বেনিফিট বলে কিছু নেই। ইউরোপিয়ান ইকোনমিতে হোটেলসহ ব্যবসায়ীদের পয়সা দিয়েছে। আমরা কাউকে দিইনি। আমরা লোন দিয়েছি। সুদসহ তা ফেরত দিতে হবে। আমেরিকা টাকা ছাপিয়ে লোককে দিয়েছে। এখন ১০ শতাংশ মুদ্রাস্ফিতি, আমরা নোট ছাপিয়ে দিলে ১৫-২০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখতে পেতাম। মেরেকেটে ৩০ শতাংশ ভ্যাকসিনেশন ফ্রি। মানুষকে বলেছি গ্যাটের পয়সা দিয়ে কিনতে। অনলাইন শিক্ষায় ডেটার দাম বরং বেড়েছে। লকডাউন ঠিক মাসে হয়েছিল কিন্তু ভুল বছরে হয়েছে। মার্চ ২০২০-এ লকডাউন করেছিলাম। হওয়া উচিত ছিল মার্চ ২০২১-এ ডেল্টার আগে। লকডাউন করে কোনও লাভ নেই। বাংলায় যাঁরা কথা বলছি মনে রাখতে হবে দুজন বাঙালি সুনেত্রা গুপ্ত অক্সফোর্ড, আরেকজন জয় ভট্টাচার্য স্ট্যানফোর্ড। তাঁরা কোভিড অতিমারীর প্রথম দু মাসের মধ্যে বলেছিল লকডাউন মাথা থেকে বাদ দাও। সময়টা খারাপ যাবে। মানুষকে ধনেপ্রানে মেরো না অর্থনীতির হাঁটু ভেঙে দিও না।

প্রশ্ন- গ্রামবাংলায় আবাস যোজনায় রাজপ্রাসাদের মালিকের নাম আছে। গরীবের নাম নেই। সামাজিক এই পরিস্থিতি, কি বলবেন?

ডাঃ কুণাল সরকার- গণতন্ত্রে আগেও জমিদার ছিল, শোষণ করত। আগেও একনায়কতন্ত্র ছিল। দেশের, রাজ্য পঞ্চায়েত স্তরে একই ফ্যাসিজম চলছে। ফ্যাসিজম ও গণতন্ত্রের পার্থক্য দাঁড়াচ্ছে আগে ভোট ভোট পুতুল খেলাটা খেলত না। এখন এই পুতুল খেলাটা খেলছ। আর এই গণতান্ত্রিক প্রসেসটা একটা গেট ওয়ে রেভেনিউ। সেই আলাদিনের গুহার দরজাটা। আজ যদি পুরসভা বা পঞ্চায়েতে কাউন্সিলর বা সদস্য হতে পারি প্যানকার্ড চুলোয় যাক। আজ তোমাকে তোমার প্যানকার্ডের ওপর বেঁচে থাকতে হচ্ছে। তোমার হাতে যখন রাজনৈতিক রত্নটা হাতে আসছে তখন তোমার হাতে তো একলক্ষ লোকের প্যান কার্ড। তুমি কাউকে শোষণ করবে, কাউকে ধমকাবে, কারও ট্যাক্সের পয়সা চুরি করবে।

প্রশ্ন- সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূলের কোনও মিল আছে?

ডাঃ কুণাল সরকার- তাঁরা যত ফুটানি মেরেছে তা সরকারের টাকায়। নিজেদের সরকার ৩৪ বছর বাদ চলে যাওয়ার পর রবিবার একটা পিকনিক করার পয়সা নেই কারও। গণতন্ত্রের আমলে পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪টা ভুঁইয়া আছে। তাঁরা ভূমিশ্বর। যারা ৩৪ বছরে ভূমিস্বর ছিল তাদের আজকে এই অবস্থা কেন? রাজ্যের সম্পদ তো ব্যক্তিগত হয়ে গিয়েছে। তাই বের হচ্ছে না। প্রথমে রাজ্যের টাকা নিয়ে সম্মেলন, সার্কাস করলাম। সিপিএমের সাপোর্ট উধাও হয়ে গিয়েছে, আসলে সিপিএমের রিসোর্স উধাও হয়ে গিয়েছে। কারণ সিপিএম আজ সেই ইনভেস্ট করবে না। সেই পথেই তৃণমূল। একদিন যখন তৃণমূলের এই সময়টা চলে যাবে কেউ মঙ্গলগ্রহ থেকে এসে তৃণমূলকে হারাবে সেদিন তাঁদেরও এই অবস্থা হবে। যত রাজনৈতিক ফুটানি তা জনগণের টাকায়। আবাস যোজনা এগুলি হচ্ছে যে রাজ্যের সম্পদে ভাগ বসাচ্ছি।

প্রশ্ন- ছাত্র রাজনীতি বন্ধ, সামাজিক অবক্ষয় কি বলবেন?

ডাঃ কুণাল সরকার- সমাজকে একটাই কথা বলার। একজন দার্শনিককে পৃথিবীতে তাঁকে মেনে চলি। জেমস বন্ড। লিভ ও লেফ্টট লিভ। তুমি করছো করে বেঁচে থাকো, আমি ডালভাত খাই। তুমিও চালাও আমিও চালাই। তুমি একটু প্যান প্যান করো আমি মাঝে মধ্যে একটু প্যান প্যান করি। তুমি প্রতিদিন আমাকে তিনবার ল্যাং মেরে ফেলার চেষ্টা করো না। আমিও তোমাকে দিনে তিনবার ল্যাং মেরে ফেলার চেষ্টা করব না।

প্রশ্ন- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এঁদের সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?

ডাঃ কুণাল সরকার- আমার মনে হয় দুজনের মধ্যে সাঙ্ঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হল আমাদের চোখে দেখা পশ্চিমবঙ্গের একজন মানুষ যাঁর কোনও এনটাইটলমেন্ট ছিল না। বার্থ সার্টিফিকেট ছিল না। যে আমাদের শান্তিনিকেতনি ক্যালকাটা ক্লাবে না জন্মে, যে লড়ে আজ একটা জায়গায় গিয়েছে, ২০ বছর ফেল করার পর। তাঁর মনের মধ্যে, মাথার মধ্যে সাইকোলজিক্যাল টেনাসিটি এবং লড়ে যাওয়ার যে ক্ষমতা, আমার কাছে এটা ভারতবর্ষের ইতিহাসে অলমোস্ট ইউনিক। ইন্ডিয়ান সেন্স অব পলিটিক্স আমার একটু ভোতা সেন্স অব হিস্টিরিটা একটু তীক্ষ্ণ। আমি ভারতবর্ষের এই গোত্রের নেতা-নেত্রীর খুব একটা খবর পাইনি। বাল থাকারেকে বাদ দিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইউনিক পার্সোনালিটি।

অন্য দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২ দশক সংগ্রামের পর অনঅভিজাত নন অ্যারিস্ট্রকেট বাঙালি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে যে জায়গায় গেলেন, তাঁকে একটা বিরাট সমঝোতা করতে হয়েছে তাঁর ফান্ডামেন্টাল সেন্ট্রাল পলিসির সঙ্গে। তিনি ক্ষমতায় এসেছেন একটা বিরাট শ্রেণিকে বঞ্চনার মধ্য দিয়ে। যাকে কলার ধরে ক্ষমতায় এলেন তিনি আবার তাঁকে ফুলচন্দন দিয়ে ডেকে আনলেন। এই যে কন্ট্রাডিকশন এক্সিকিউশন পলিসি এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অতিক্রম করতে পারলেন না।

মোদীর পরিকাঠামো তৈরি। ২০১৪ থেকে ২০২২-এর মধ্যে মোদী অনেকগুলো কাজ করেছে। যা স্বাভাবিক ভাবে মাশলম্যানের মতো না এগোলে ওই কাজ ভারতে করতে দেড়শো বছর সময় লাগতো। ডিজিট্যাল ইন্ডিয়া, ডিজিট্যাল ইকোনমি, রোডওয়ে, পরিকাঠামো। জাতীয় পরিকাঠামো গঠন ও জাতীয় অর্থনীতি মোদীর প্লাস সাইড, মোদীর হিসাবের খাতাটা যেদিন লেখা হবে সেদিন ডেবিট সাইডে থাকবে ন্য়াশন বিল্ডিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিভিশন অব সোসাইটি। এটা মোদীর দলের কেন্দ্রীয় নীতি। দুজনের এক গালে রসগোল্লার রস আছে, আরেক দিকে মুখের মধ্যে তিক্ততার স্বাদ আছে। সম্ভবত সেটাই ওদের লাইফ। এই লাইফ নিয়ে চলতে হবে।

দেশের রুজি রোজগার দেশের নিট লাভ হয়েছে মোদীর অধীনে। সোসাইটির লাভ কম হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ মেশালি সমাজ একসঙ্গে রাখতে পেরেছেন, সোসাইটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পজিটিভ দিক, কিন্তু রাজ্যের পরিকাঠামো গঠন ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাঁর দুর্বল জায়গা। চাকরি বিক্রি করেও ভাগ বসাচ্ছি। চিকিৎসা ব্যবস্থা চালাতে গেলেও কন্ট্রোল চলছে। স্বাস্থ্য ভবনে বসে কাউকে যদি চমকাতো না পারো তাহলে কি বাবু হলে?

west bengal politics Dr. Kunal Sarkar
Advertisment