প্রতি বছরই রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় দেবী দুর্গার ডাকের গয়না। এই ডাকের সাজের গয়নার সঙ্গেই সুনাম জড়িয়ে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরের ঝুরিয়া গ্রামের। পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলেও দ্রব্যমূলের এই বাজারে যেন ঝিমিয়ে রয়েছে এই শিল্প। কোনওমতে সংকটকে সঙ্গী করেই চলছে কাজ। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং সেই তুলনায় চাহিদা কম থাকায় ধুঁকছে এই শিল্প। তবুও প্রাচীন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে দেবী দুর্গা ও তাঁর ছেলে-মেয়েদর জন্য ডাকের সাজের গয়না বানাচ্ছেন শিল্পীরা।
দুর্গাপুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে। আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা, এরপরেই কৈলাস থেকে মায়ের মর্ত্যে আগমন। বাপের বাড়িতে মা সাজবেন রাজ-বেশে। তাঁর গায়ে থাকবে শোলার গয়না, মাথায় সোনার মুকুট। এই শোলা মায়ের ভীষণ প্রিয়। কিন্তু যাঁরা এই শোলার গয়না তৈরি করেন সেই মালাকাররা, কেমন আছেন? তারই খোঁজ-খবর করতে আমাদের প্রতিনিধি পৌঁছে গিয়েছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে।
পুরান অনুযায়ী, হিমালয় কন্যা পার্বতীর সঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেবের বিয়ে চূড়ান্ত হয়। বিয়েতে সাদা মুকুট পরার ইচ্ছা প্রকাশ করেন মহাদেব। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার ওপর সেই মুকুট তৈরির ভার পড়ে। মহাদেবের ইচ্ছায় তৈরি হয় এক ধরনের নরম গাছ। পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় শোলা গাছের। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল অন্য জায়গায়। শোলার মত নরম হালকা সামগ্রী দিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত নন স্বয়ং বিশ্বকর্মাও। সেই সমস্যার কথা তিনি জানালেন মহাদেবকে। তখন মহাদেবের ইচ্ছায় জলাশয়ে এক সুকুমার যুবকের আবির্ভাব ঘটল। মালাকার হিসেবে পরিচিতি পেলেন সেই যুবক। তৈরি হল মহাদেবের শোলার মুকুট। সেই থেকেই বিস্তার হয় মালাকার সম্প্রদায়ের।
দেবী দুর্গাকে পরানো হয় এই ডাকের সাজে। এই ডাকের সাজ কথাটার পিছেনেও একটা গল্প আছে। পলাশির যুদ্ধের পর থেকে কলকাতায় বনেদিবাড়িতে দুর্গোপুজোর চল শুরু হয়। সেই সময়ে প্রতিমার সাজ আসতো জার্মানি থেকে। ডাক মারফত সেই সাজ আসতো বলে একে বলা হয় ডাকের সাজ।
আরও পড়ুন- জাগ্রত দেবী গুহ্যকালী, যাঁর পুজো দিতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন ভক্তরা
মালাকার সম্প্রদায় দেবীর গয়না তৈরি করে চলেছেন বছরের পর বছর ধরে। মাঝে দু'বছর করোনার জেরে ব্যাপক মন্দা নেমে এসেছিল এই শিল্পে। তবে এবার ফের একবার পুরনো ছন্দে দুর্গোপুজো। পুরোদমে চলছে ডাকের সাজ বানানোর কাজ। শুধুই লাভের অঙ্কে নজর রেখে গয়না বানান না এঁরা। মা দুর্গা ও তাঁর গোটা পরিবারকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে তোলাই একমাত্র লক্ষ্য এঁদের।
পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর ২ নং ব্লকের ঝুরিয়া গ্রাম। এই গ্রামেরই বাসিন্দা জয়দেব গিরি একজন শোলা শিল্পী। সারা বছর এই ডাকের শিল্পের সঙ্গেই যুক্ত তিনি। তিনি বলেন, ''ভালোবাসা থেকেই কাজ করি। তবে লাভের ঘরটা আমাদের শূন্যই থাকে। রকেট গতিতে বাড়ছে আঠা, চুমকি, শোলার দাম। কীভাবে এই ব্যবসা ধরে রাখব সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।''
আরও পড়ুন- কলকাতায় এসেছিলেন রানি এলিজাবেথ, স্বাগত জানাতে শহরের রাজপথে বসেছিল তোরণ
শুধু জয়দেববাবুই নন, এতল্লাটের এমন বহু ঘরে ডাকের সাজ তৈরি হয়। প্রত্যেকেই একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। একদিকে থিম পুজো জনপ্রিয়তা পাওয়ায় ডাকের সাজের বরাত কমেছে। অন্যদিকে, বাজারে ডাকের সাজ তৈরির কাঁচামালেরও দাম বেড়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দারুণ আর্থিক সংকটে রয়েছেন শিল্পীরা। প্রাচীন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি হস্তক্ষেপের দাবি জনিয়েছেন তাঁরা।