দরিদ্রদের জন্য প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় নজরকাড়া দুর্নীতি। প্রকল্পে বাড়ি অমিল যোগ্যদের। তালিকায় রয়েছে প্রভাবশালীদের নাম। সুবিধাভোগীদের তালিকা দেখলে চোখ কপালে উঠবে। বেশ কিছু দিন ধরেই আবাস দুর্নীতিতে উত্তাল সারা বাংলা। দিদির 'দূত'দের ঘিরে চলছে বিক্ষোভ। জেলায় জেলায় ফাঁস হয়েছে দুর্নীতির পর্দা।
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় রাজ্যের প্রায় প্রতিটি গ্রাম থেকে এসেছে দুর্নীতির অভিযোগ। দীর্ঘদিন পর কেন্দ্রীয় আবাস যোজনায় বরাদ্দ ঘোষণা হতেই বেরিয়ে পড়েছে দুর্নীতির পাহাড়। ইতিমধ্যেই দুর্নীতির অভিযোগ গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কানেও। এবার দুর্নীতির বহর দেখতে ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় দলের সদস্যরা এসে পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখেছেন।
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার জন্য নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসারে, যাঁদের নিজস্ব বাড়ি নেই এবং আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি, তাঁরাই যোগ্য দাবিদার। কিন্তু দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের তদন্ত অনুযায়ী যা উঠে এল, তাতে রীতিমত চোখ কপালে উঠবে। আমাদের তদন্তে, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বাংলায় দুর্নীতির পাহাড় ধরা পড়েছে।
কীরকম দুর্নীতি? বাংলার আবাস যোজনার সুবিধাভোগীর তালিকায় রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু প্রভাবশালী নেতার নাম। প্রশাসনের নির্দেশেই তৈরি হয়েছে সেই তালিকা। কী করে যোগ্য দাবিদারদের উপেক্ষা করে শাসক দলের প্রভাবশালী নেতাদের নাম উঠেছে সেই তালিকায়, এনিয়েই শুরু হয়েছে বিস্তর চর্চা। দুর্নীতির শিকড় ঠিক কতটা গভীরে, তা আঁচ করতে বাকি নেই কেন্দ্রীয় দলের সদস্যদের। স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিবাদ না-হলে, এনিয়ে বিস্তর হইচই না-হলে এতক্ষণে আবাস যোজনার বরাদ্দ অর্থ দিব্যি পকেটে পুরতেন শাসক দলের নেতা-কর্মীরা। পূর্ব বর্ধমানের সিপিএম জেলা কমিটির সদস্য অপূর্ব চ্যাটার্জি বলেন, 'স্থানীয় কর্মচারীদের যোগসাজশেই হয়েছে পুরো দুর্নীতি। বর্তমানে এই ইস্যুটি বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে বিতর্কে পরিণত হয়েছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে বিজেপি।'
গত বছর আট মাসেরও বেশি সময় ধরে রাজ্যে প্রকল্পটি স্থগিত রাখার পরে নভেম্বরে কেন্দ্র অবশেষে ১,১৩৬,৪৮৮টি PMAY-G বাড়ির জন্য ৮,২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। এই প্রকল্প ঘিরে রাজনৈতিক ঝড়ও তুলেছে শাসক দল। টিএমসির তরফে দাবি করা হয়েছে, কেন্দ্র অন্যায়ভাবে রাজ্যের শাসক দলকে টার্গেট করছে। এর মধ্যেই উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিজেপি নেতা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের বাবাকেও কোচবিহারে প্রকল্পের সম্ভাব্য সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে তুমুল তরজা। সাফাইয়ে, 'রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’-র তত্ত্ব খাড়া করেছেন বিজেপি নেতা নিশীথ প্রামাণিক।
আরও পড়ুন: < তাপস ছাড়াও আর কে টাকা নিয়েছিল? চেঁচিয়ে বললেন ‘১৯ কোটি’র কুন্তল >
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সত্যিটা বুঝতে পূর্ব বর্ধমান, উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার একাধিক এলাকা ঘুরে দেখে দুর্নীতির একটা চিত্র পাওয়ার চেষ্টা করেছে। এই তিন জেলার গ্রামাঞ্চলে আবাস প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তদন্তে দেখেছে, তৃণমূল আশ্রিত পঞ্চায়েতের উপপ্রধান থেকে শুরু করে পার্টির কোর কমিটির সদস্য, স্থানীয় তৃণমূল কর্মী, যাঁদের ইতিমধ্যেই পাকা বাড়ি রয়েছে, আর্থিক ভাবেও প্রভাবশালী- তাঁদের নামও উঠে এসেছে আবাস যোজনার তালিকায়।
এবিষয়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তাঁদের মধ্যে একজন সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে 'ত্রুটিহীন' বলে দাবি করেছেন। অন্য একজন বলেন, 'আবাস যোজনায় যে নাম রয়েছে, সেটাই আমি জানি না।' তৃতীয় একজন জানিয়েছেন, নাম দেখেই তিনি বিডিওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। নাম মুছে ফেলার জন্য অনুরোধও করেছেন। যদিও আবাস যোজনায় নিয়ন্ত্রণের অভাবকে দুষেছেন নিচুতলার প্রশাসনিক আধিকারিকরা। বেশ কয়েকজন বিডিও দাবি করেছেন, প্রভাবশালীদের নাম ইতিমধ্যেই মুছে ফেলা হয়েছে। কিন্তু, তালিকায় অভিযুক্তদের নাম এল কোথা থেকে, তার কোনও পরিষ্কার উত্তর তাঁরা দিতে পারেননি।
তালিকায় রয়েছে বর্ধমানের তৃণমূল নেতা তথা খণ্ডঘোষের শাখারি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান জাহাঙ্গির শেখের স্ত্রী সীমা, তাঁর ভাই আলমগির ও আজমগির এবং তাঁদের বাবা শেখ মহসিনের নামও। তদন্তে দেখা গিয়েছে, গ্রামেই সিসিটিভি মোড়া সুবিশাল অট্টালিকা রয়েছে জাহাঙ্গিরের। তালিকায় এমনও নাম রয়েছে, যাঁরা বর্তমানে 'মৃত'।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিনিধিরা যখন কেশবপুর গ্রামে জাহাঙ্গিরের বাড়িতে যান, সেই সময় তিনি বাড়ি ছিলেন না। ফোনেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। মেসেজ পাঠানো পর্যন্ত হয়েছিল। কিন্তু, তিনি কোনও উত্তর দেননি। এরপর, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিনিধিরা টিএমসির ব্লক প্রেসিডেন্ট অপার্থিব ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অপার্থিব বলেন, 'মানুষ যখন আবাস যোজনায় বাড়ি পাচ্ছে না, সেই সময় জাহাঙ্গির দুটো প্রাসাদের মত বাড়ি বানিয়েছে। জাহাঙ্গিরের আগে মাটির বাড়ি ছিল। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতার পর থেকে চালের ব্যবসা শুরু করল। তারপর থেকেই বেশ ভালো কামাচ্ছে।'
খণ্ডঘোষের বিডিও সত্যজিৎ কুমারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিনিধিরা। সত্যজিৎ কুমার বলেন, '২০১৮-য় সমীক্ষা হয়েছিল। এই সমীক্ষায় বিডিওর কোনও হাত ছিল না। পঞ্চায়েতের লোকজনই মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সমীক্ষা করেছিল।' বিডিওকে জাহাঙ্গির শেখের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অবশ্য বলেন, 'ওর নাম তো কোনও প্রতিবাদ হওয়ার আগেই তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।'
এখান থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে জামালপুর ব্লকের শুঁড়েকালনায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোতলা বাড়ি স্থানীয় তৃণমূল অঞ্চল সভাপতি নিতাই কুণ্ডুর। তাঁর নামও ছিল আবাস যোজনার তালিকায়। নিতাই কুণ্ডু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, 'দলের একশ্রেণির নেতা তাঁর বদনাম করতেই তালিকায় নাম ঢুকিয়ে দিয়েছিল। দলে তো গোষ্ঠীবাজি আছেই। আমি নাম বাদ দেওয়ার জন্য বিডিওর কাছে আবেদন করেছি।' জামালপুরের বিডিও শুভঙ্কর মজুমদার বলেন, 'এটা ২০১৮ সালে সমীক্ষা হয়েছিল। আমি তখন এই ব্লকে ছিলাম না। এখনও পর্যন্ত এই ব্লকে ২১,০০০ নামের মধ্যে ৬,৫০০ নাম তালিকা থেকে বাদ গেছে।'
এখান থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে রায়নার হরিপুর গ্রামে পাকা বাড়ি রায়না ১ পঞ্চায়েতের সভাপতি রত্না মহান্তর। তাঁর নামও আবাস তালিকায় ছিল। পরবর্তীতে তিনিও তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার আবেদন করেছেন। রত্না মহান্ত বলেন, 'এখনও আমাদের মাটির বাড়ি আছে। দলের একাংশ ও আত্মীয়-স্বজনের সাহায্যে পাশে পাকা বাড়ি বানানো হয়েছে। তাই আমি আবাস যোজনার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার আবেদন করেছি।'
উত্তর ২৪ পরগনার হাবরা ব্লকের পূর্ব রুদ্রপুর গ্রামে বাড়ি তৃণমূল নেতা কবিরুল হকের। তৃণমূলের স্থানীয় এই কোর কমিটির নেতার টাইলস বসানো পাকা বাড়ি। পাশে নিজস্ব রেডিমেড পোশাকের কারখানাও আছে। সেখানে প্রায় ১২ জন কর্মী কাজ করেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিনিধিরা যাওয়ার সময় বাড়িতে ছিলেন কবিরুল হক। তাঁর স্ত্রী পারভিন বলেন, 'আবাস যোজনার তালিকায় যখন আমার স্বামীর নাম ছিল, তখন আমাদের মাটির বাড়ি ছিল। তিন বছর আগে এই পাকা বাড়ি আর কারখানা করেছি।' হাবরা ব্লক ১-এর বিডিও জয়ন্ত দে বলেন, 'কিছুদিন আগেই কবিরুল নাম বাদ দেওয়ার আবেদন করেছিল। তাঁর নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, পাকা বাড়ির কোনও মালিক যেন আবাস যোজনার বাড়ি না পায়।'