Advertisment

ফেভারিট কেবিনে রান্নাঘরের পাশে সুড়ঙ্গ কেন জানেন?

বহিরঙ্গে মলিন হলেও আড্ডাছন্দে এখনও সবুজ ফেভারিট কেবিন। শতবর্ষ পার করে সম্প্রতি ১০১ বছরে পা দিয়েছে কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এই চা-ঘর।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
favourite cabin kolkata nostalgia

ফেভারিট কেবিনের অন্তঃপুর

বদলে যাওয়া কলকাতার বুকের ভিতরে একশো বছরের পুরনো লম্বাটে এক চা-ঘর। সেখানে শ্বেতপাথরের গোল টেবিল, শতাব্দীপ্রাচীন কাঠের চেয়ার, প্রাচীন পাত্রে সর্বক্ষণ ফুটছে চায়ের জল। খাবার বলতে সাকুল্যে কয়েকটি আইটেম। চা, টোস্ট, কাটা কেক, প্যানকেক। এই সামান্য আয়োজনেই উপচে পড়ে ভিড়। সিসিডি, বারিস্তার মতো নামীদামী কফিশপের দাপট সামলে ঐতিহ্যের খুঁটিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সূর্য সেন স্ট্রিটের ফেভারিট কেবিন। বহিরঙ্গে মলিন হলেও আড্ডাছন্দে এখনও সবুজ। শতবর্ষ পার করে সম্প্রতি ১০১ বছরে পা দিয়েছে কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এই চা-ঘর।

Advertisment

ফেভারিট কেবিনের যাত্রা শুরু ১৯১৮ সালে। চট্টগ্রামের বাসিন্দা নতুনচন্দ্র বড়ুয়া কলকাতায় এসে ৬৯, সূর্য সেন স্ট্রিটের একটি আয়তকার ঘরে দোকান খুলে বসলেন। সঙ্গে ছিলেন ভাই গৌর বড়ুয়া। দোকান সাজানো হল বেশ কয়েকটি শ্বেতপাথরের গোল টেবিল দিয়ে, প্রতিটি টেবিলের সঙ্গে একাধিক কাঠের চেয়ার। দোকানের ঠিক মাঝামাঝি ক্যাশ কাউন্টার, সেখানে নতুনবাবু বসতেন। তার পিছনে দোকানের দ্বিতীয় অংশ, ঠিক যেন অন্দরমহল। সবশেষে রান্নাঘর। রান্নাঘরের ডানদিকে একটি সুড়ঙ্গ। চায়ের দোকানে সুড়ঙ্গ কেন? সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

আরও পড়ুন: রাজ কাপুরকে ফিরিয়ে দেন সত্য়জিৎ, রবি-তপেনকে নিয়েই হয় ছবি

নতুনবাবুরা ধর্মে বৌদ্ধ, তাই তাঁদের দোকানে মাছ, মাংস বা ডিমের প্রবেশাধিকার নেই। ১০০ বছর পার করেও সেই ঐতিহ্যই বহন করে চলেছে ফেভারিট কেবিন। এখনও তাদের প্রতিটি খাবারই নিরামিষ, এমনকি কেকগুলিও 'এগ-লেস'। নিরামিষ খাবারের কারণে কিন্তু জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়ে নি কখনও। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার ক্রেতা-দোকানদার, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া-অধ্যাপক, হিন্দু হস্টেলের আবাসিক, কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক কর্মীদের নয়নের মণি হয়ে থেকেছে ফেভারিট কেবিন।

অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, অনুশীলন-যুগান্তর-বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের অগ্নিযুগের সশস্ত্র লড়াই, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঝোড়ো দিনগুলিতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনেকের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে এই আড্ডাঘর। স্বাধীনতার পরে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বামপন্থী আন্দোলন পেরিয়ে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় কফি হাউজের পাশাপাশি ফেভারিট কেবিনও ছিল যাবতীয় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। শুধুমাত্র রাজনীতিই তো নয়, শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ফেভারিটের অবদান অনস্বীকার্য। ফেভারিট কেবিনের সঙ্গে কল্লোল যুগের সাহিত্য আন্দোলনের লগ্ন হয়ে থাকার কথা লিখেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। প্রসঙ্গত, ১৯৭০ সালে একবার ফেভারিট কেবিনের চায়ের দাম ২৫ পয়সা থেকে ৩০ পয়সা করা হয়েছিল। সেই পাঁচ পয়সা মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সংবাদপত্রে চিঠি লিখেছিবেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

কারা আসতেন ফেভারিট কেবিনে? প্রশ্নটা কিঞ্চিত বদলে নিয়ে বলা যায়, কে নয়! লম্বা জানলার পাশে চার নম্বর টেবিলে বসে খোলা গলায় গান ধরতেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁকে একের পর এক গানের অনুরোধ করতেন সদ্য কলেজ পেরোনো যে তরুণ জাতীয়তাবাদী নেতা, তাঁর নাম সুভাষচন্দ্র বসু। ব্রিটিশ পুলিশ সর্বক্ষণ নজর রাখত এই দোকানের উপর। তাদের কাছে খবর ছিল, শ্বেতপাথরের টেবিলগুলির কয়েকটি আসলে সশস্ত্র ধারার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ঠেক। সেই খবর মিথ্যাও নয়। ক্যাশ কাউন্টারের পিছনে দোকানের যে অন্দরমহল, সেখানে বসতেন অনুশীলন সমিতি, যুগান্তরের বিপ্লবীরা। মাঝেমধ্যেই দোকানে হানা দিত পুলিশ। তখন ক্যাশ কাউন্টারের টেবিলে প্লেট দিয়ে শব্দ করতেন নতুনবাবু। সিগন্যাল পেয়ে রান্নাঘরের পাশের সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে চম্পট দিতেন বিপ্লবী যুবকের দল।

আরও পড়ুন: গান নিয়ে দিনভর ‘গানহীন’ তরজায় কবীর সুমন-বাবুল সুপ্রিয়

আসতেন শিবরাম চক্রবর্তী। দেওয়ালঘেঁষা একটি টেবিল ছিল তাঁর প্রিয়। অন্য কোনও টেবিলে বসতেন না। যদি ওই নির্দিষ্ট টেবিলটি ভর্তি থাকত, শিবরাম দাঁড়িয়ে থাকতেন পাশে। তাঁকে চিনতে পেরে টেবিল ছেড়ে দিতেন অন্যেরা। আসতেন প্রবোধকুমার সান্যাল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রদ্ধানন্দ পার্কে সভাসমিতি সেরে আসতেন জ্যোতি বসু। 'অপুর সংসার' মুক্তি পাওয়ার আগে থেকেই আসতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নকশালবাড়ি আন্দোলনের উত্তপ্ত দিনগুলিতে টেবিল ভরিয়ে রাখতেন বামপন্থীদের তিন তরফের ছাত্রনেতারা। এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়।

১৯৮৭ সালে নতুনবাবুর মৃত্যুর পর দোকানের দায়িত্ব নেন তাঁর দুই ছেলে দিলীপ ও বাদল বড়ুয়া। এখনও সকাল-সন্ধ্যে উপচে পড়ে ফেভারিট কেবিন। রাজনৈতিক কর্মী, কবি, প্রকাশক, ছাত্রছাত্রী, মানবাধিকার কর্মীরা ভরিয়ে রাখেন টেবিল। শতবর্ষ পেরিয়ে আসা মলিন দোকানে এত ভিড় কিসের আকর্ষণে? নিছকই নস্টালজিয়া না অন্য কিছু? গত ৬০ বছরের নিয়মিত খদ্দের বৌবাজারের রতন মল্লিক বলেন, "জানি না। দোকানটা কেমন যেন যাপনে মিশে গিয়েছে। না এসে পারি না।"

kolkata
Advertisment