ধনীরাম টোটো। বয়স ৫৯। আলিপুরদুয়ারের টোটোপাড়ার ধনীরাম টোটো ইতিমধ্যে দুটি উপন্যাস লিখেছেন। রাজ্য সরকারের অনগ্রসর উন্নয়ন বিভাগে কর্মরত ধনীরাম টোটো হরফ আবিস্কার করে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে। স্ত্রী প্রয়াত। বিলুপ্তপ্রায় টোটো জনজাতির সংখ্যা ১,৬০০-এর কিছু বেশি। প্রথার বাইরে গিয়েও টোটোজাতির লিপি তৈরি করা নিয়ে রীতিমতো বিপ্লব করেছেন ধনীরাম টোটো। তিনি একান্তে কথা বলেছেন 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার' সঙ্গে।
প্রশ্ন- আপনি পদ্মশ্রী পুরস্কার পাচ্ছেন?
ধনীরাম টোটো- আমার কাছে এখনও কোনও খবর আসেনি। তবে আমার কাছে বায়োডেটা চেয়েছিল। আমি একমাস আগে পাঠিয়ে দিয়েছি। আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দাদের প্রতি শুভেচ্ছা রইল। আমি তো এখনও কোনও কাগজ পাইনি। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে ফোন এসেছিল আপনি পুরস্কার পেতে পারেন বলে।
প্রশ্ন- আপনি টোটো লিপির জন্য পুরস্কার পেয়েছেন।
ধনীরাম টোটো- জীবনে কিছু মানুষ আসে যায়। এটা তো নিত্য ব্যাপার। জাতির জন্য কিছু কাজ করে যাওয়াটা আমাদের কর্তব্য। আমার কথা হল জাতিকে, দেশকে ভালবাসা সম্মান করাটা সব থেকে বড়। মানুষ তো আসবে যাবে। আমরা যদি কিছুই না করি। শুধু খেয়ে-দেয়ে মরে যাব, এটা কি হয় নাকি। এটা কি হতে পারে? আমরা বুঝেও যদি কিছু না করে থাকি এটা দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক।
প্রশ্ন- কত দিন লেগেছিল টোটো ভাষায় হরফ লিখতে?
ধনীরাম টোটো- প্রায় ৬ মাস লেগেছিল। এই হরফ নিয়ে অনেক জায়গায় আলোচনা করেছি। অনেক জায়গায় বলেছি কেশ বিন্যাস করে উকুন বের করে ভাল করুন। এটাকে অঙ্কন করে রূপদান করুন। সহযোগিতা চেয়েছি। এটাই শেষ কথা নয়। একটা ইংরেজির বি তৈরি করে অনেক কিছু হয়েছে। এটা প্রাথমিক তৈরি করেছি। এটাকে নিয়ে আরও কাজ করলে আরও ভাল হবে এটা আমি বলেছিলাম।
প্রশ্ন- টোটো লিপি কবে করেছিলেন?
ধনীরাম টোটো- ২০১৮-তে কাজটা শেষ করেছিলাম। তবে অনেক আগে থেকেই গবেষণা করেছি। এটা আমি দার্শনিক হিসাবে করেছিলাম। এটাতে ফিলোজফি আছে। বানানের পিছনে অনেক অর্থ আছে। এটা এক সপ্তাহের মধ্যে শিখে নিতে পারবেন। এটা অপ্রথাগত অক্ষর। এ-র পরে বি, তারপর সি লিখতে হবে। এক্ষেত্রে তার দরকার নেই। আপনাকে অক্ষরটা চিনতে হবে। এরপর শব্দ তৈরি করতে পারবেন। বাক্যগঠন করতে পারবেন। প্রত্যেকটা অক্ষরের ক্ষেত্রে ফিলোজফি আছে। মানে বুঝিয়ে দিলেই বাক্য তৈরি করতে পারবেন। ক-এর পর খ থাকবে, গ-এর পর ঘ থাকবে। এখানে তেমন কিছুর দরকার নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, প্রথাগত ভাবে ডিগ্রি পাওয়া যাবে। কিন্তু অপ্রতাগত ভাবেও তো পড়াশুনা করা যায়।
প্রশ্ন- টোটোদের পড়াশুনা করে চাকরি জুটছে না
ধনীরাম টোটো- ধনঞ্জয় আমার ছেলে। সে টোটোদের মধ্যে প্রথম স্নাতকোত্তর। অনেককে বলেছিলাম, আমার ছেলের চাকরি হল না। ১২-১৬ লক্ষ টাকা আমি কোথায় পাব বলুনতো? এখানে লাইব্রেরি আছে। ২০ বছর ধরে এখানে কোনও লাইব্রেরিয়ান নেই। আমার ছেলে লাইব্রেরি সায়েন্স নিয়ে পড়েছে। প্রচুর পোস্ট ফাঁকা আছে। কাগজেই চাকরির ঘোষণা দেখতে পাই। কিভাবে চাকরি হচ্ছে তা জানি না। কে পাচ্ছে, কিভাবে পাচ্ছে তা বুঝতে পারছি না।
প্রশ্ন- চাকরি না পেয়ে টোটোদের কি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে?
ধনীরাম টোটো- সরকারি কর্মচারি হিসাবে এ নিয়ে আমি কিছু বলতে পারি না। তবে এটুকু বলতে পারি আমাদের মধ্যে ১০ জনের ওপর গ্রাজুয়েট আছে। সরকারি দফতরে চাকরি পেলে সমাধান হয়ে যায়। দিদিই জানেন। আমি তো দিদির বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি না। আমার বলার কোনও ভাষা নেই। আমার আক্ষেপ, ১৬-১৭ জনকে চাকরি দিতে পারল না রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার!
এরফলে ড্রপআউট বাড়ছে। আমার ছেলেকে দেখিয়ে বলছে এমএ পাশ করে ওর কিছু হল না। আমাদের পড়াশুনা করে কি হবে? আমার ছেলের চাকরি না হলেও অন্যদের পড়াশুনা করা দরকার। আমি একথা বললেও আমার কথা কেউ শুনতে চায় না। আমার ছেলের না হলেও তোমার হবে না সেকথা ঠিক নয়। বারে বারে একথা আমি বলে থাকি। ওরা আঙুল তুলে আমাকে বলছে তোমার ছেলের তো এত পড়াশুনা করে চাকরি হল না। আমি বলছি আমার কিছু করার নেই। চাকরির জন্য বয়সের ব্যাপার আছে। আমি তবু পড়াশুনার জন্য উৎসাহিত করি।
প্রশ্ন- তাহলে টোটো যুবকরা কি করছে?
ধনীরাম টোটো- এরা সব এখন পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে গিয়েছে। আমার ছেলেও বলছে বাবা সিকিম চলে যাব। ওখানে গিয়ে কাজ করব। প্রায় ৩০০-এর ওপর মানুষ সিকিম চলে যাচ্ছে কাজ করতে। এদের মধ্যে গ্রাজুয়েট, উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিক পাশ করা ছেলেরাও রয়েছে। এটা আমার কাছে অত্যন্ত দুঃখজনক। ওখানে গিয়ে পাথর কাটা, ইলেকট্রিক লাইন, বিভিন্ন কনস্ট্রাকসনের কাজ করছে। কেউ আবার উত্তারঞ্চলে চলে যাচ্ছে।
প্রশ্ন- সরকারের কাছে কি আবেদন রাখবেন?
ধনীরাম টোটো- সরকারের কাছে আমার আবেদন সবার সুবিচার করা হোক। সবার জন্য চিন্তা করুক। আমরা পিছিয়ে পড়া জাতি, আমরা উন্নত জাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পড়াশুনা করতে পারব না। টোটো জাতির জন্য আগে যেমন সরকার ১০ কোটা দিত। সেই ব্যবস্থা থাকুক। ১০ জন করে টোটোরা চাকরি পাক আমি সরকারের কাছে এটা আশা করি।
প্রশ্ন- টোটো ভাষায় কত জন কথা বলে?
ধনীরাম টোটো- এখনও প্রায় ১০০ জন টোটো ভাষায় কথা বলে। আমাদের সামাজিক সভায় টোটো ভাষায় ভাষণ দিতে হয়। সেখানে অন্য ভাষা চলবে না। টোটোজাতির উন্নতির বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কিছু মানুষ আছেন আঞ্চলিক ভাষা জানে ভুটিয়া, বোড়ো, ডয়া। কিন্তু বয়স্করা কেউ কেউ বাংলা ভাষা জানে না।
প্রশ্ন- জঙ্গলঘেরা অঞ্চলে বসতি টোটোদের। কি বার্তা দিতে চান?
ধনীরাম টোটো- গ্রামে হাতি চলে আসে। আমরা তো হাতি, বাঘ, বুনোদের সঙ্গে সহাবস্থান করে বসবাস করে থাকি। ওরা ক্ষতি করলেও আমরা মেনে নিই। ওরা জঙ্গলে থাকবে আমরা গ্রামে থাকব। আমরা বনদফতরের কাছে কখনও দাবি করি না আমাদের সুপারি ভেঙে দিয়েছে। আমরা মনে করি ওদের বাঁচার দরকার আছে। আমাদেরও বাঁচতে হবে। ওদেরও পেট আছে আমাদেরও আছে। জঙ্গল থাকলে আমাদের মঙ্গল হবে। জঙ্গল না থাকলে আমিও তো বাঁচব না। জঙ্গলে আমাদেরও আধিকার থাকবে। টোটোরা মনে করে হাতিরও অধিকার আছে। চিতা বাঘ থাকবে। তা নাহলে বনের সৌন্দর্য থাকবে না। জঙ্গল নষ্ট হোক কখনও চাই না। জঙ্গলে গাছ লাগানো দরকার। অরন্য আরও সবুজ হোক, অরন্য ফিরিয়ে দিতে হবে। জঙ্গল ব্যবহার করলে প্রত্যেককে ২০টা গাছ লাগানো উচিত।
প্রশ্ন- আপনি তো রীতিমতো টোটো ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার লড়াই করছেন।
ধনীরাম টোটো- আমি ৬ জনকে পিএইচডি করিয়েছি। নিজে মাধ্যমিক পাশ করা কিন্তু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁদের পড়িয়েছি বুঝিয়েছি। ওঁরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভাল ফল করেছে। তার মধ্যে কেউ কেউ অধ্যাপক হয়েছেন, কেউ আবার বিশ্ব ব্যাংকে চাকরি করছে।