পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি মামলায় বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবকে গ্রেফতারে উত্তাল হয়েছিল ভারতের রাজনীতি। রীতিমতো হইচই শুরু হয়েছিল সারা দেশজুড়ে। পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছিলেন সিবিআইয়ের বাঙালি আধিকারিক আইপিএস ডঃ উপেন বিশ্বাস। দু'দিন আগেও লালুপ্রসাদের সাজা ঘোষণা হয়েছে এই কেলেঙ্কারির একটি মামলায়। কোটি কোটি টাকার আর্থিক তছরুপে শয়ে শয়ে অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। পশু খাদ্য কেলেঙ্কারির তদন্তের মোড় ঘোরানো এক্সক্লুসিভ কাহিনী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে শোনালেন ডঃ উপেন বিশ্বাস। তিনি জানিয়েছেন, এই তদন্তে অসম্ভব চাপ ছিল।
সিবিআইয়ের মামলায় বিহারের পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির তদন্ত ইতিহাস তৈরি করেছে। প্রায় ৬৭টি কেসের প্রত্যেকটাতেই চার্জশিট দিয়েছে সিবিআই, সাজাও হয়েছে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে সিবিআইয়ের প্রাক্তন অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর উপেন বিশ্বাস বলেন, 'আমার টিম ক্র্যাক হয়েছে। তবে কোর টিম এক ছিল। কার জেল হবে জানি না। তবে যে প্রমাণ পেয়েছি তাতে প্রত্যেকটা কেসে চার্জশিট করব। এই বিষয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম। তিন মাসের মধ্যে সমস্ত ডকুমেন্ট এক জায়গায় করে একটা বই বানিয়ে নিয়েছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম প্রত্যেকটা কেসে জিতে যাব।'
এই তদন্তে সফল হওয়ার পিছনে যে ফাইলগুলি সব থেকে বেশি কাজে এসেছে, তা এই প্রথম প্রকাশ্যে খোলসা করেছেন উপেনবাবু। তাঁর কথায়, 'এই প্রথম সামনে আনলাম এই ঘটনা।'
উপেন বিশ্বাস বলেন, 'একজন আইএএস অফিসার একদিন লুকিয়ে আমার বাড়িতে আসে। তিনি ছিলেন অ্যানিম্যাল হাজবেন্ডারির সেক্রেটারি। বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদ। ওই দিন মধ্যরাতে তিনি আমার কাছে আসেন। তিনি তছরুপের ভাগিদার ছিলেন না। আমাকে এসে বলেন, আমি ওদের কথায় রাজি হইনি। আমাকে গভর্মেন্ট অব ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দেবে। তা নিয়ে চিন্তাও করছি না। আমি অফিসে সব ফাইল সাজিয়ে রেখেছি। আপনি কাল আমার অফিসে এসে তল্লাশি করুন। আর ফাইলগুলো সব বাজেয়াপ্ত করে নিন। ওর মধ্যে আপনি সব কিছু পেয়ে যাবেন। আমার নাম করলে ওরা গুলি করে মেরে দেবে। এসব শুনে আমি তাঁকে আশ্বস্ত করি, আমার কাছে কোনওদিন তুমি আসনি! আমি তোমার কোনওদিন নাম করব না। আর তুমি আমাকে চেনো না।'
সিবিআইয়ের দোর্দন্ডপ্রতাপ প্রাক্তন আধিকারিক বলেন, 'পরেরদিন খুব সকালে সেই অফিস ঘিরে ফেলা হল। দিনভর তল্লাশি চলল। অফিসের সব ফাইল আমরা নিলাম। আসল ফাইল দেখে 'কনভিনসড' হয়ে গিয়েছিলাম। দেখলাম কাজ হয়ে গিয়েছে। আর কেউ পালাতে পারবে না।'
এছাড়া আরও দু'টি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন সিভিল সার্ভিসের এই প্রাক্তনী। তিন বলেন, 'এই কেলেঙ্কারিতে আর্থিক তছরুপের তদন্তের আবেদনে করে অনেকগুলি পিআইএল হয়েছিল। পিআইএল করা জৈনিক ব্যক্তি অনেকগুলি সোর্স থেকে অরিজিনাল ফাইলের জেরক্স কপি আমাকে দিয়েছিলেন। আর একটি ঘটনাও এক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হয়, তা হল বিশিষ্ট রাজনীতিক জর্জ ফার্ন্ডাডেজ আমাকে টেলিফোন করেন। তখন তিনি ক্ষমতায় নেই। প্রথম দু'বার ফোন ধরিনি। তৃতীয়বার ফোন ধরি। আমি তাঁকে রেসপেক্ট করতাম। ফোন ধরতেই উনি আমাকে বলেন, আমরা শুনেছি আপনাকে ওরা ইনফ্লুয়েন্স করবে। কেসটা ডায়ালুট করে দেবে। আমি বলি, জর্জ এই কেস আমার ডেড বডির ওপর দিয়ে ডায়লুট হবে। অবশ্য পরে বিভিন্ন সময় আমাকে শাস্তি দেবে ভেবেছিল, তখন সে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল।'
রাঘববোয়ালদের সিবিআই ধরতে পারে না। ধরলেও সাজা দেওয়া সহজ হয় না। উপেনবাবুর কথায়, 'সিবিআইয়ের বদনাম রাঘব বোয়ালদের সিবিআই ধরতে পারে না। তাঁদের শাস্তি হয় না। একটা বড় কেস করতে হলে দু-একজন পলিটিক্যাল ব্যক্তিত্বকেও খুঁজে নিতে হবে। কেউ কেউ এখনও সৎ আছে।'
পাটনার সাধারণ মানুষও ব্যাপক সমর্থন করেছিল সিবিআইয়ের প্রাক্তন অ্যাডিশনাল ডিরেক্টরকে। অবসরের পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ একবছর এক্সটেনশন পেয়েছিলেন। কীভাবে বিহারের মানুষ এই আধিকারিককে সমর্থন করেছিল সেই প্রসঙ্গে উপেনবাবু বলেন, 'একদিন রাতে বার বার টেলিফোন আসছিল। ফোনটা ধরতেই ওদিক থেকে বলতে থাকে আমরা এক্সট্রিমিস্ট। আপনি লালু যাদবের নিরাপত্তা ছেড়ে দিন। আপনার পুরো বাড়ি আমরা ঘিরে আছি। আপনার নিরাপত্তা আমাদের হাতে। এরপর আর একদিন দেওঘর থেকে টেলিফোন আসে। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলে, আমরা সারা দিন ধরে কীর্তন করেছি যাতে আপনি সংরক্ষিত থাকে। এই বিহারের লোক আপনার সঙ্গে আছি।'
সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি প্রায় ১০ বছর পার করেছে। চার্জশিট বা তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে সিবিআই সাংবাদিক বৈঠক করে কোনও ঘোষণাও কখনও করেনি। আবার বিরোধীদের অভিযোগ, নির্বাচনের আগেই সক্রিয় হয়ে ওঠে সিবিআই-সহ অন্য কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি। গ্রেফতার বা তল্লাশির ধুম পড়ে যায়। উপেনবাবুর কথায়, 'সারদা কেস এতদিন হয়ে গেল কী হচ্ছে আমরা জানি না। ট্রায়াল হলে, প্রোগ্রেস করলে সাংবাদিক বৈঠকে করে জানাতে হবে। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির তদন্তে আমরা চার্জশিট বা গ্রেফতার নির্বাচনের আগে করতাম না। সাধারণত ১০-২০ বছরের আগে কেস শেষ হয় না। ১০ বছরের আগে রেজাল্ট পাওয়া যাবে না। আমি অবসরের আগে জেলে যাচ্ছে এটা হবে না।'
পরবর্তীতে নানা তদন্তের ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে সিবিআই পারবে তো। প্রাক্তন এই সিবিআই আধিকারিক বলেন, 'এই রেপুটেশন তখন ছিল না। এখন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। এটা শুনে আমারও গায়ে লাগে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেখানে যুক্ত, সেখানে হস্তক্ষেপ হবেই। তবে আমরা সাধারণ মানুষের কাছে দায়বদ্ধ, এটা মনে রাখতে হবে।'