২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের দামামা প্রায় বেজেই গিয়েছে। সম্প্রতি ৩ রাজ্যে বিজেপির বিপুল জয় ইন্ডিয়া জোটকে আপাতত চাপে ফেলে দিয়েছে। কংগ্রেসের ডাকা দিল্লিতে ৬ ডিসেম্বরের জোট বৈঠক বাতিল করতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছে সনিয়া-রাহুল। এদিকে তৃণমূল কংগ্রেস এবারের লোকসভা নির্বাচনে আসন বৃদ্ধি করতে বদ্ধপরিকর। একইসঙ্গে সাংগঠনিক ভাবে দলকে মজবুত করতেও তৎপর ঘাসফুল শিবির। রাজনৈতিক মহলের মতে, বৃদ্ধতন্ত্র নিয়ে দলের প্রকাশ্য বিদ্রোহ যে একেবারেই লোকদেখানো নয়, লোকসভার পার্থী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। কোন কোন সাংসদ এবার টিকিট পাচ্ছেন না তা নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে রাজনৈতিক মহলে।
বয়ঃবৃদ্ধি ঘটলে শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করার শক্তি কমে যায়। তাই নতুনদের জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। তা নিয়ে লাগাতার ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন বিধানসভায় তৃণমূলের মুখ্যসচেতক তাপস রায়। উত্তর কলকাতার তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করে তাপস রায়ের এই মন্তব্য শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। এমনকী তিনিও সময় হলে রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন বলে জানিয়ে ছিলেন। সম্প্রতি তৃণমূলের মুখপাত্র ও রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষও বৃদ্ধতন্ত্র নিয়ে সোচ্চার হন। রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমতি ছাড়া তো এসব মন্তব্য করা সম্ভব নয়। আপাতত পরিবেশ তৈরির কর্মসূচি চলছে। অর্থাৎ বাজিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া। প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। ফল মিলবে ২০২৪-এ।
তবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর যাঁরা তাঁর নেতৃত্ব মানব না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তাঁদের নেত্রী বলে শোরগোল জুড়েছিলেন তাঁরা ইতিমধ্যে যুবরাজের নেতৃত্বে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। ২০২১-এ দায়িত্ব নেওয়ার পর অভিষেকের প্রথম ঘোষণা ছিল এক ব্যক্তি এক পদ। পাশাপাশি যুব শক্তির নেতৃত্ব। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে এক ব্যক্তি এক পদ নীতি কার্যকরী হয়েছে। ২৩ নভেম্বর নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অভিষেকহীন সাংগঠনিক বৈঠকে খোদ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এক ব্যক্তি এক পদের কথা কৌশল করে আপামর নেতৃত্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মমতার বক্তব্য ছিল, ইচ্ছে না থাকা সত্বেও তাঁকে দু'টি দায়িত্বে রেখে দিয়েছে দল। এই নীতির বাইরে কলকাতার মেয়র ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, মহিলা সাংগঠনিক সভানেত্রী ও মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যসহ ব্যতিক্রমী কয়েকজন আছেন। এই নীতিও যে কার্যকরী হতে চলেছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, মত অভিজ্ঞ মহলের।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচন ও পরে উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতীকে জয়ী ১০ জনের বয়স ৬৫ বছরের ওপরে। ৬০ বছরের ওপরে আছেন আরও কয়েকজন। ৬৫ বছরের ওপরের তালিকায় রয়েছেন- চৌধুরী মোহন জাটুয়া (৮৫), শিশির অধিকারী (৮২), সৌগত রায় (৭৭), শত্রুঘ্ন সিনহা (৭৭), সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (৭৫), প্রসূণ বন্দ্যোপাধ্যায় (৬৮), অসিত মাল (৬৮), কল্যান বন্দ্যোপাধ্যায় (৬৬), মালা রায় (৬৫), সুনীল মণ্ডল (৬৫)।
প্রথম দফায় নিশানায় ছিলেন সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর বয়সজনিত বিষয়ে দমদমের সাংসদ সৌগত রায়কে টার্গেট করেছেন কামারহাটির বিধায়ক মদন মিত্র। সৌগত রায়ের বয়স ৭৭ বছর, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ৭৫ বছর। ইতিমধ্যে এবিষয়ে দিল্লিতে প্রতিক্রিয়াও জানিয়ে দিয়েছেন সুদীপ। বলেছেন, 'আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত এবং অভিমত মেনে চলি। যদি দল এরকম কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে দলের সকলকেই মেনে চলতে হবে।' আসানসোলের বিজেপির সাংসদ গায়ক বাবুল সুপ্রিয় পদত্যাগ করার পর ওই কেন্দ্র থেকে জয় পান তৃণমূল প্রার্থী অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা। তাঁরও বর্তমান বয়স ৭৭। কাঁথি থেকে তৃণমূলের প্রতীকে জয়ী শিশির অধিকারীর বয়স ৮২। তাঁর সাংসদ পদ বাতিলের জন্য লোকসভার অধ্যক্ষকে আবেদন করেছে তৃণমূল। তাঁর মেজ ছেলে শুভেন্দু অধিকারী এখন বিরোধী দলনেতা। নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত করেছেন।
বর্ধমান পূর্ব লোকসভার সাংসদ সুনীল মন্ডলের বয়স ৬৫। তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে পদ্মশিবিরে যোগ দিয়েছিলেন, এখন আবার ঘাসফুলে ফিরে এসেছেন। তাঁর বিজেপি ঘুরে আসার বিষয়টা এখনও জোর চর্চায় রয়েছে দলের অন্দর মহলে। ৬১ বছরের ব্যারাকপুরের বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং ক্যামাকস্ট্রিটে অভিষেকের অফিসে গিয়ে তৃণমূল ফিরে এসেছেন। ছেলে পবন সিং ভাটপাড়ার বিজেপি বিধায়ক। বোলপুরের তৃণমূল সাংসদ অসিত মালের বয়স ৬৮ বছর। হাওড়ার তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় ৬৮। শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যান বন্দ্যোপাধ্যায় ৬৬। অভিষেক নেতৃত্বে পাওয়ার পর সব থেকে বেশি সোচ্চার ছিলেন কল্যান। দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূল সাংসদ মালা রায় ৬৫। চৌধুরী মোহন জাটুয়া একসময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। মথুরাপুরের এই তৃণমূল সাংসদদের বয়স ৮৫ বছর। এর বাইরে তৃণমূলের বেশ কয়েকজন সাংসদের লোকসভার হাজিরার হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
এর বাইরে 'এক ব্যক্তি এক পদ' নীতি সত্যিই কার্যকরী হলে বাতিলের তালিকার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।