বারিকুল। একটা সময়ে জঙ্গলমহলের এই নাম ছড়িয়ে পড়েছিল রাজ্যের সর্বত্র। একসময়ের মাওবাদী শীর্ষ নেতা রঞ্জিত পালের বাড়ি এই বারিকুলের খেজুরখেন্না গ্রামে। কেমন আছে রঞ্জিত পালের পরিবার? কী বলছে রঞ্জিত পালের বাবা, ভাই? দাদার আন্দোলনে এখনও গর্ব বোধ করেন ভাই হরিপদ পাল।
কলকাতা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে রয়েছে বাঁকুড়ার বারিকুলের খেজুরখেন্না গ্রাম। মূল রাস্তা থেকে গ্রামের দিকে বাঁক খেয়ে ২০০ মিটারের বাড়ি প্রাক্তন মাও শীর্ষ নেতা রঞ্জিত পালের। গ্রামে ঢোকার মুখে ঢালাই রাস্তা দেখে মনে হতে পারে ভিতরেও তাহলে এমনই ঝাঁ চকচকে যোগাযোগ। কিন্তু গ্রামের ভিতরে ঢুকতেই ভুল ভাঙবে। এই ভোটে রাস্তার দাবিও রয়েছে এখানে।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই স্কুল থেকে আর বাড়ি ফেরেননি কিশোর। তখনই রঞ্জিত জড়িয়ে পড়েছিলেন মাওবাদী আন্দোলনে। পরবর্তীতে বাংলা-ওডিশা-ঝাড়খন্ড সীমান্তের আঞ্চলিক কমিটির নেতা। খুন, অপহরণ-সহ একাধিক অপরাধে অভিযুক্ত। বিভিন্ন রাজ্য তাঁকে ধরে দেওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। কিষেণজির মৃত্যুর পর শীর্ষ নেতা হিসাবে রঞ্জিতের নাম চর্চায় ছিল। শেষমেশ ২০১৭ সালে স্ত্রী ঝর্ণা গিরিরর সঙ্গে কলকতায় আত্মসমর্পণ করেন রঞ্জিত।
কিন্তু দীর্ঘ কয়েক বছর বাড়িতে না থাকা, সেই সময়ে ঘন ঘন বাড়িতে পুলিশের আগমন এখনও স্মৃতিতে টাটকা রয়েছে রঞ্জিতের বাবা, কাকা, ছেলে সহ পরিবারের সকলের। এখন রঞ্জিত এই বাড়িতে থাকেন না। পরিবারের সদস্যরা জানান, তিনি এখন হোমগার্ডের চাকরি করেন, কলকাতায় থাকেন।
বারিকুল যাওয়ার রাস্তায় খেজুরখেন্নার মোড়ে রঞ্জিতের বাড়ির খোঁজ করতেই দেখা মিলল তাঁর ভাই হরিপদ পালের। ওই মোড়েই ছোট্ট ঘুমটির দোকান হরিপদর। চাকরির প্রতিশ্রুতি দিলেও পুলিশের তরফে এই দোকান মিলেছে তাঁর। দাদার আন্দোলনের জন্য প্রায় ১৮ বছর ভুগতে হয়েছে এই পরিবারকে। নিজেদের মাটির বাড়িতে গিয়ে খাটিয়ায় বসে হরিপদ শোনাল ১৮ বছরের নানা স্মৃতি।
বছর তেত্রিশের হরিপদ বলেন, 'জঙ্গলমহলের মানুষের উন্নয়নের জন্য আন্দোলন করেছিলেন দাদা। আমরা তাই গর্ব অনুভব করি। জনগণের জন্য লড়াই করেছিল। কারণ, ক্ষেতমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষরা যাতে জল পায়, খাবার পায়, আলো পায়। তখন জঙ্গলমহলে সর্বত্র বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল না। জঙ্গলমহলের মানুষকে তুচ্ছ মনে করত। আন্দোলন করার ফলে জঙ্গলমহলের মানুষ এখন শান্তিতে আছে। জল, বিদ্যুৎ জঙ্গলমহলের মানুষের কাছে পৌঁছিয়েছে।'
এক বিঘে জমিতে চাষাবাদ আবার কখনও মজুরি খাটে হরিপদ। রাস্তার পাশে আছে গুমটির দোকান। সংসারে রয়েছে বাবা-মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে। বড় ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে, ছোট ছেলে প্রথম শ্রেণিতে। একটা সময় রটেছিল রঞ্জিতের পায়ে গুলি লেগেছে। রঞ্জিতের দীর্ঘ বছর বাড়িতে না থাকা প্রসঙ্গে হরিপদ বলেন, '১৮ বছরের মধ্যে বাড়িতে একদিনও আসেনি দাদা। মাঝে মাঝেই বাড়িতে পুলিশ আসতো। তবে দাদার গুলি লাগার খবর ঠিক নয়। শরীরে কোনও দাগ নেই। মিথ্যা প্রচার করেছিল পুলিশ-প্রশাসন। এখন দাদা কলকাতায় স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে থাকেন। ওঁকে হোমগার্ডের চাকরি দিয়েছে সরকার।' এদিকে, এই ঝামেলার মাঝে আর পড়াশোনাটাই হয়ে ওঠেনি হরিপদর।
রঞ্জিত, হরিপদর বাবা শোনালেন ছেলের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কাহিনী। সত্যনারায়ণ পাল বলেন, ' ছেলে স্কুল থেকেই পালিয়ে গিয়েছিল। আর বাড়ি ফেরেনি। আমরা যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোনও খোঁজ পাইনি। কোথায় আছে শুনতে পেলেই ছুটে যেতাম। কিন্তু দেখা হত না।' তিনি বলেন, 'বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ১৭-১৮ বছর বাদে দেখেছি ছেলেকে। যখন ছেলে আত্মসমর্পণ করেছিল তখন সরকার ডেকে নিয়ে গিয়েছিল কলকাতায়। তখন দেখা হয়েছিল। তারপর কখনও কখনও বাড়িতে আসত। দলেরই একজনকে বিয়ে করেছে। ছোট ছেলের অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে ৩ হাজার করে টাকা দেওয়ার কথা প্রশাসনের। তা-ও সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না।' রঞ্জিতের বাবার আফশোষ, 'কোনও সরকারি ভাতা পাই না। দুয়ারে সরকারে কাগজ জমা দিয়েও কিছু হয়নি। বলেছিল ছেলেকে চাকরি দেবে, দিল না। রাস্তার পাশে ঘুমটির দোকান করে দিয়েছে পুলিশ। একটা সময়ে পুলিশের যাতনায় খাবার খেতে পারতাম না। পাতের খাবার ফেলে ঘর ছেড়ে পালাতে হত।'
আরও পড়ুন- রেয়াত পেল না স্কুলছাত্রও, ভোট সন্ত্রাসের মর্মান্তিক বলি নাবালক পড়ুয়া!
রঞ্জিতের কাকা হাবু পাল তাঁদের বাড়ির পাশেই থাকেন। ভাইপোর জন্য তাঁকেও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তিনি বলেন, 'মানুষের জন্য করেছে। যেটা ভাল বুঝেছে করেছে। ১৬ বছরেই বাড়ি ছেড়েছিল রঞ্জিত। আত্মসমর্পণ করার পর বাড়িতে এসেছে। তার মাঝে কোনও দিন আসেনি। প্রথম থেকে দেখছি পুলিশ আসছে-যাচ্ছে। আমি ঘুমিয়ে আছি। আমাকে তুলে নিয়ে চলে গিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরালো। আমাকে নিয়ে যেতে চাইছে। পুলিশের প্রচুর জ্বালাতন সহ্য করতে হয়েছে। খাওয়া-ঘুমে কোনও শান্তি ছিল না।'
এদিকে, পঞ্চায়েত ভোট জমে উঠেছে এই খেজুরখেন্না গ্রামেও। না পাওয়ায় দাবি রয়েছে এই গ্রামেও। হরিপদর স্ত্রী মন্দিরার দাবি, 'পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা করতে হবে। সকালে টাইম কলে জল দিলে আর বিকেলে জল দেবে না। খুব অসুবিধা হচ্ছে। দিনে দুবার অন্তত জল দিক।' এলাকায় আবাস যোজনার সঠিক দাবিদাররা অনেকে বাড়ি পাননি বলেও অভিযোগ। তাই আবাস যোজনার বাড়ির দাবি করছেন মন্দিরাও।