কার্তিক পুজোয় মেতেছে পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া। গতকাল ছিল পুজো, আজ শনিবার কার্তিক লড়াই। কাটোয়ার পাশাপাশি পূর্বস্থলী, হুগলির বাঁশবেড়িয়া, মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা কার্তিকপুজোর জন্য পরিচিত। কেন এই লড়াই? তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। তবে আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি গবেষক ড. স্বপনকুমার ঠাকুরের মতে, জমিদারদের লেঠেলদের লাঠিখেলাই ছিল কার্তিক লড়াই। আরেক পক্ষের মতে শোভাযাত্রা নিয়ে কে আগে যাবে তা নিয়েই লড়াইয়ের সূত্রপাত। তবে এই মতামতকে মানতে রাজি নয় কাটোয়ার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা ড.স্বপনকুমার ঠাকুর।
কার্তিক লড়াই কী?
আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি গবেষক ড. স্বপনকুমার ঠাকুর বলেন, 'কার্তিক লড়াই কেন বলা হত? থাকার পুজো যখন আস্তে আস্তে শুরু হল তখন জমিদারদের মধ্যে বিসর্জনের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত তাঁদের লাঠিয়ালদের মধ্যে। সেটা থেকেই লড়াই। এক জায়গায় গিয়ে ঠাকুরগুলোকে দাঁড় করাত। প্রতিমাগুলোকে কাঁধে করে নিয়ে যেত। যার ফলে বিশ্রামের প্রয়োজন হত। নির্দিষ্ট পয়েন্ট করে দর্শকদের দেখানো হত। চলমানের মধ্যে স্থায়িত্বের বৃত্ত তৈরি হত, সেখানে বিনোদনের জন্য জমিদারদের লাঠিয়ালদের মধ্যে একটা লাঠি খেলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত। এটাই লড়াই। জমিদাররা বিজয়ীদের মেডেল দিত। বহু পুরনো মানুষদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানতে পেরেছি। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত এই লড়াই হয়েছে। যত দিন জমিদারিটা পূর্ণ গৌরবে ছিল।'
প্রাচীন তিন কার্তিক পুজো:
কাটোয়ার কার্তিক পুজোর শুরু নিয়েও নানা মতামত রয়েছে। কিন্তু এই জনপ্রিয় পুজোর মধ্যে তিনটে পুজোর ইতিহাস অত্যন্ত প্রচীন। কাটোয়ার হরিসভা পাড়ার ল্যাংটো কার্তিক, কাটোয়ার ছুঁতোর পাড়ার বাংড়াকার্তিক, তাঁতি পাড়ার তন্তুবায়ীদের সাত ভাই কার্তিক। তিনি বলেন, 'এই তিন কার্তিক পুজো আনুমানিক ১৮ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখন খুব ধুমধাম না হলেও পুজো হত। উপাচার, রীতিনীতিতে তা স্পষ্ট।'
কাটোয়ায় কার্তিক পুজোর ইতিহাস:
তবে পুজোর শুরু নিয়ে ড. স্বপন কুমার ঠাকুরের বক্তব্য, কাটোয়ার ইতিহাস রচনা করেছিলেন আজ থেকে ১০০ বছর আগে নিবারণ চট্টোপাধ্যায়। কাটোয়া সম্পর্কে তিনি অনেক তথ্য দিয়েছেন কিন্তু কার্তিক পুজো তখন আদৌ হতো কিনা সে সম্পর্কে কোনও তথ্য মেলেনি তাঁর লেখায়। বোঝা যাচ্ছে ব্যাপক মাত্রায় হলে তাঁর নজর এড়াত না। কাটোয়ার ইতিহাস বইতে কার্তিক পুজো ও লড়াই নিয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। এর থেকে ধরে নেওয়া যায় বিশ শতকের প্রথম দিকে থেকে কাটোয়ার জমিদাররা কার্তিক পুজোকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
সন্তান হওয়ার জন্য পুজোর সূত্রপাত?
প্রচলিত মত রয়েছে বারবনিতারা পুত্র সন্তানের আশায় কার্তিক পুজো করতেন। কাটোয়ায় কার্তিক পুজোর শুরু নিয়ে এমন মতামতও শোনা যায়। এই যুক্তি মানতে নারাজ গবেষক। ড. স্বপনকুমার ঠাকুর বলেন, 'বারবনিতাদের সঙ্গে কার্তিকের সম্পর্ক খুব পুরনো। একসময় দক্ষিণ ভারতে দেবদাসী প্রথার প্রচলন ছিল। লোকশ্রুতি বা পূরাণ মতে দেবদাসীরা অবিবাহিত ছিল। বিয়ে করার সুযোগ পেত না। কার্তিক হল চিরকুমার। লোকশ্রুতি মতে দেবদাসীদের তিনি বিবাহ করেছিলেন। দেবদাসীদের সঙ্গে কার্তিকের গভীর সম্পর্ক ছিল। দেবদাসীদের পূজনীয় দেবতা ছিলেন কার্তিক। কালক্রমে দেবদাসীরা বারবনিতাতে কনভার্ট হয়েছে। কিন্তু কার্তিকের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়নি। সুতরাং বারবনিতা বা পতিতালয় গঠিত হয়েছিল তাঁরাই পুজোটা বেশি বেশি করে করত। সন্তান হওয়ার জন্য নয়। এখন সেটাকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। ব্রহ্মপূরাণ হিসাবে কামুক দেবতা হলেন কার্তিক। দেবদাসীদের আরাধ্য দেবতা হল কার্তিক। গৃহদেবতা হিসাবে কার্তিক পুজো হত।'
বাংলায় কার্তিক পুজোর ইতিহাস:
বাংলায় কার্তিক পুজোর ইতিহাস বলতে গিয়ে তিনি জানান, বাংলায় মূলত উত্তরবঙ্গে কার্তিক পুজোর প্রচলন ছিল। মহাস্থানগড়ের খননে খ্রীষ্টিয় এক-দুইয়ে বাংলার কার্তিকের প্রাচীন নিদর্শন মিলেছে। কাটোয়া, পূর্বস্থলী, বাঁশবেড়িয়া, বেলডাঙা, গাঙ্গেয় এলাকায় কার্তিক পুজো অনেক পরের ঘটনা। বনিক সম্প্রদায় মূলত এই কার্তিক পুজোর আয়োজন করত। কাটোয়া অঞ্চলের মঙ্গলকোটে খননে কার্তিকের মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। তবে বিস্তারিত কোনও তথ্য মেলেনি। এটা সম্ভবত গুপ্তোত্তর পর্বের মূর্তি হতে পারে।
কার্তিক পুজোয় 'থাকা' কী?
'থাকা' শব্দের সঙ্গে কার্তিক পুজো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কী এই থাকা? তাতে কতগুলি মূর্তি থাকে? ড. স্বপনকুমার ঠাকুর বলেন, 'সিঁড়ির ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে দক্ষিণ ভারতীয় শিল্প রীতি। কলকাতায় ঝুলনের সময় এমনভাবে দেখানো হত। থাকার সর্বোচ্চ অবস্থানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জগদ্ধাত্রী থাকে। তাঁর কোলে থাকে শিশু কার্তিক। সিঁড়িগুলিতে থাকে সখী। জমিদারীতন্ত্রের হিসেবে সুন্দরী মেয়েরা থাকতো। ১২ জন সখী নৃত্যশৈলীতে থাকে। সর্বোচ্চ ৬০টি পুতুলের থাকা হয়। মাঝামাঝি ৪০-৫০-ও থাকে। থাকা বাড়লে দু'পাশের সখীও বাড়বে। থাকার পুতুল শিল্প রামায়ন, মহাভারত পুরান ভিত্তি করে পালা সৃষ্টি করা হতো। এতে পুরো যাত্রা শিল্পের প্রভাব রয়েছে। গ্যালারির প্রতি সিঁড়িতে ৫টা করে পুতুল থাকছে। যাত্রাপালার মতো একজন নির্দেশক থাকেন।