তিন দিন অতিক্রান্ত। এখনও রাজু ঝা খুনের রহস্যভেদ করতে পারেনি পুলিশ। তবে নিখুঁত পরিকল্পনা করেই যে ইডির ডাক পাওয়া রাজ্যের খনি অঞ্চলের 'বেতাজ বাদশা'কে খুন করা হয়েছে সেই ব্যাপারে অন্তত আর কোনও দ্বিমত নেই পুলিশকর্তাদের। এই খুনে ঝাড়খণ্ডের সুপারি কিলাররা যুক্ত থাকতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। এক্ষেত্রে আতসকাঁচের নীচে গরু পাচারের কিংপিন 'ফেরার' আব্দুল লতিফের ভূমিকা।
কয়লা পাচার মামলায় রাজু ঝার ইডি দফতরে হাজিরা দেওয়ার দিন ছিল গত সোমবার। তার ঠিক একদিন আগে অর্থাৎ গত শনিবার রাত ৮টা নাগাদ শক্তিগড়ে কলকাতামুখী ২ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে একটি ল্যাংচার দোকানের সামনে দাঁড়ায় সাদা রঙের একটি ফরচুনা গাড়ি। ওই গাড়ির চালকের বাঁদিকের আসনে বসেছিলেন কয়লামাফিয়া রাজু ঝা। গাড়ির পিছনের আসনে বসেছিলেন রাজু ঝার সহযোগী ব্রতীন মুখোপাধ্যায় ও সিবিআইয়ের তদন্তাধীন গরু পাচার মামলায় ফেরার অভিযুক্ত আব্দুল লতিফ। ওই ফরচুনা গাড়ির পিছনেই নীল রঙের একটি চারচাকা গাড়ি এসে দাঁড়ায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, ওই দিন শক্তিগড়ে ল্যাংচার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভয়ানক কাণ্ড ঘটে যায়। নীল রঙের গাড়িটি থেকে কয়েকজন নেমেই একেবারে শার্প শুটারের কায়দায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই ফরচুনা গাড়ির আরোহীদের লক্ষ্য করে পরপর গুলি চালায়। গুলি চালিয়েই নীলচে রঙের গাড়িতে চেপেই দুষ্কৃতীরা দ্রুত কলকাতামুখী রোড ধরে পালিয়ে যায়। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় রাজু ঝার শরীর। পিছনের আসনে বসে থাকা রাজুর সহযোগী ব্রতীন মুখোপাধ্যায়ের বাম হাতে গুলি লাগে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আব্দুল লতিফ ও তাঁর গাড়ির চালক নুরের শরীর দুস্কৃতীদের ছোঁড়া একটিও গুলি স্পর্শ করেনি। আর এই ঘটনার দিন রাজু ঝার সঙ্গে একই গাড়িতে যে আব্দুল লতিফও ছিল সেটা ১ এপ্রিল শক্তিগড় থানায় দায়ের করা অভিযোগে লতিফের গাড়িচালক নুরই স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
ঘটনার পর গুলিবিদ্ধ দু’জনকে উদ্ধার করে ঘটনাস্থলের অদূরের অনাময় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা রাজু ঝাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ব্রতীন মুখোপাধ্যায়ের বাম হাতে অস্ত্রোপচার হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সোমবার তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান। ওই দিনই ব্রতীন ও লতিফের গাড়ির চালক নুরকে পুলিশ টানা জিজ্ঞাসাবাদ চালায়। কিন্তু তার পর থেকে ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও খুনিদের একজনেরও নাগাল পুলিশ পায়নি। আততায়ীদের ব্যবহৃত নীল গাড়িটি ও গাড়িটি থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, কার্তুজ, একাধিক নম্বর প্লেট পুলিশ পেলেও আব্দুল লতিফ এখনও বেপাত্তাই। এই খুনের ঘটনার তদন্তে খুব শীঘ্র 'ব্রেক থ্রু' পাওয়া যাবে বলে সোমবার জেলা পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন আশাপ্রকাশ করলেও মঙ্গলবার দিনভর তদন্তে তেমন বিশেষ কোনও তথ্য উঠে আসেনি বলেই পুলিশ সূত্রের খবর।
আরও পড়ুন- কাজ দেখে উচ্ছ্বসিত মুখ্যমন্ত্রী! দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের দরজা খোলা সময়ের অপেক্ষা
তবে সিটের সদস্যদের কাছে তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে যে আততায়ীদের ব্যবহার করা নীল গাড়িটি জায়গা করে নিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই গাড়িতে চেপেই সুপারি কিলাররা শক্তিগড়ে এসে রাজুকে খুন করে চম্পট দিয়েছে বলে সন্দেহ পুলিশের। রাজু খুনে সুপারি কিলার কাজে লাগানো হয়েছে বলেও সন্দেহ পুলিশের। ঘটনার কিনারা করতে পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডে চষে বেড়াচ্ছে রাজ্য পুলিশের বিশেষ দল।
আরও পড়ুন- শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশে প্রাণের আরাম, বাংলার অনিন্দ্যসুন্দর এই সাগরতট এককথায় অদ্বিতীয়!
সূত্রের দাবি, “ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জায়গার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। ঘটনার দিন ১ এপ্রিল ভোরে একটি নীল চারচাকা গাড়ি ঝাড়খণ্ডে যায় বলে। তারপর ওই দিনই দুপুরে ঝাড়খণ্ডের কোনও ডেরা থেকে সুপারি কিলারদের চাপিয়ে নিয়ে একই নীল চারচাকা গাড়ি শক্তিগড়ের উদ্দেশে রওনা হয়। ঝাড়খণ্ড যাওয়া ও ফিরে আসার সময়ে নীল গাড়িটিতে যে নম্বর প্লেট লাগানো ছিল সেই একই নম্বরের (WB 06P 3454) নীল চারচাকা গাড়ির হদিশ শক্তিগড় থানার অদূরে পায় পুলিশ। এই সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তকারী পুলিশ কর্তারা একপ্রকার নিশ্চিত যে রাজু ঝা খুনে ঝাড়খণ্ডের সুপারি কিলারদেরকেই কাজে লাগানো হয়েছিল।” ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ দল এদিন ফের একবার ওই গাড়িটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়।
আরও পড়ুন- শুভেন্দুর তীব্র নিন্দা, ‘রাজ্যপাল পদ রাজনীতির ঊর্ধ্বে’- বিতর্কের মুখে সাফ দাবি আনন্দ বোসের
এদিকে রাজু ঝা খুন ও তার পরবর্তী তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে শাসক-বিরোধী রাজনৈতিক তর্জা। জেলা বিজেপি নেতা মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র প্রশ্ন তুলেছেন, “এমন ভয়ানক একটা খুনের ঘটনার পর জেলা পুলিশ কোন যুক্তিতে নূর এবং ব্রতীনকে ছেড়ে দিল? কেন তাঁদের হেফাজতে নেওয়া হল না? পুলিশ কী করে জানল ওদের উপর কোনও আক্রমণ হবে না?'' বিজেপি নেতার এই মন্তব্যকে কটাক্ষ করে তৃণমূলের রাজ্য মুখপাত্র প্রসেনজিৎ দাস বলেন, “মৃত্যুঞ্জয়বাবু রাজনীতি ছেড়ে গোয়েন্দার কাজ নিন। পুলিশ কাকে ধরবে আর কাকে ছাড়বে সেটা সম্পূর্ণ পুলিশের ব্যাপার। মৃত্যুঞ্জয়বাবুর জেনে রাখা ভাল এই বাংলার পুলিশ আগাগোড়াই অন্য রাজ্যের পুলিশের থেকেও অনেক বেশি দক্ষ।''