Jalpaiguri Storm: এ যেন একেবারে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভূমি। সব কিছু তছনছ, লণ্ডভণ্ড পরিস্থিতি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর কয়েকদিন কেটে গেলেও চারিদিকে এখনও হাহাকার আর হাহাকার। এখনও গ্রামজুড়ে আর্তনাদের আওয়াজ। অসহায়, নিঃস্ব মানুষগুলোর সম্বল বলতে দু'চোখের জল। জলপাইগুড়ির (Jalpaiguri) ময়নাগুড়ির বার্নিশ কালিবাড়ি এলাকার বাসিন্দাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে ৩-সাড়ে ৩ মিনেটের ঝড় (Storm)। মাথার ওপর শুধু ত্রিপল আর চতুর্দিক ফাঁকা। বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল গ্রামের মানুষজন জানপ্রাণ কবুল করে আগলে রয়েছেন ভিটেমাটি।
"ফের নতুন করে শুরু করা কি সম্ভব? সব কিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।" এই কথা বলতে বলতে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন বার্নিশ কালীনগরের বাসিন্দা শিমুলি রায়। ঘরের চালা শুধু নয়, তাঁদের পুরো বাড়িটাই উড়ে গিয়েছে। দেখে মনেই হবে না সেখানে কোনও বাড়ির আদৌ অস্তিত্ব ছিল কিনা। স্বামী সতীশ রায় ব্যাঙ্ক থেকে ২ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন মুদিখানা দোকান বড় করার স্বপ্ন নিয়ে। সঙ্গে ছিল ভালো বাড়ি তৈরির ইচ্ছা। সব আশা এক বিকেলের ঝড় উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে।
এই দুর্যোগে মানসিক অবস্থা এমনই হয়েছে যে শারীরিকভাবে নড়াচড়ার ক্ষমতাও যেন হারিয়েছেন শিমুলি দেবী। সতীশ ও শিমুলির এক ছেলে ও এক মেয়ে। সতীশ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বলেন, "ঘটনার দিন আমরা চারজনই ঘরের মধ্যে চাপা পড়ে গিয়েছিলাম। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছি। জানি না জীবনে আর দাঁড়াতে পারব কি না। এদিকে যে ব্যাঙ্ক থেকে ২ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছি তাঁরা এসে দেখে গিয়েছে আমাদের এই হাল। জীবনের সব স্বপ্নই চুরমার হয়ে গিয়েছে।" সতীশের ঘরের পাশে দাদা তারাপদ রায়ও ঝড়ে বসতিহারা। মাথার ছাদ হারিয়ে তিনিও আজ গৃহহীন।
সরকারিভাবে কিছু ত্রাণ পেয়েছেন এখানকার বাসিন্দারা। কিছু বেসরকারি সংস্থাও পাশে দাঁড়িয়েছে। রান্নার জন্য স্টোভ, বাসনপত্র, চাল, ডালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতারাতি বিদ্যুতের (Electricity) ব্যবস্থাও হয়েছে। তবে মাথার ওপর পলিথিনের টুকরো ছাড়া তাঁদের থাকার কোনও সুরাহা তড়িঘড়ি করতে পারেনি সরকার। সামান্য বৃষ্টি হলেই দফারফা অবস্থা হবে সহায় সম্বলহীন মানুষগুলোর।
কৃষিকাজ করে জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখেছিলেন বছর পঁয়ত্রিশের তাপস রায়। তাঁর পাকা বাড়িতে কাঠের কাঠামোয় ছিল টিনের চাল। সেই কাঠামো ও চাল কোথায় যে ঝড়ে উড়ে গিয়েছে তা বলা মুশকিল। নিজের জীবনের লড়াইয়ের কাহিনী বলতে গিয়ে চোখ জলে ছল ছল করে উঠল তাপসের। তাঁর নিজের ৪ বিঘে জমি রয়েছে, আরও ৬ বিঘে জমি ভাগে নিয়ে চাষ করেছিলেন। ঝড়ের দাপটে ধান ও করলা চাষে কয়েক লক্ষ নষ্ট হয়ে গিয়েছে তাপস।
তাপস রায় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বলেন, "২০ বছর কলকাতায় বালিগঞ্জে একটা বাড়িতে কাজ করেছি। বিয়ে করার পর গ্রামে ফিরে নতুন করে চাষের কাজ শুরু করি। একটু একটু করে সংসার গোছাতে শুরু করি। কিন্তু ঝড়ের তাণ্ডবের পর মনে হচ্ছে এই জীবনে আর কিছু করতে পারব না। অনেক অনেক বছর পিছিয়ে পড়লাম। আর বোধ হয় নতুন করে কিছু করা সম্ভব নয়।" পাশে দাঁড়ানো স্ত্রী বনানী দাসের চোখেও তখন জল। তাপসের ঘরের পাশের ঘরে থাকতেন বাবা ৬০ বছর বয়সী রমেশ রায় ও মা প্রভারাণী রায়। সেই ঘরের মেঝে ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাঁদের সঙ্গে থাকেন তাপসের ভাই অর্জুন। পরিবারের কারও চোখে মুখে যেন তাকিয়ে থাকাই দায়।
ওই পাড়াতেই থাকেন বছর একুশের গাড়ি চালক জয়ন্ত রায়। এখনও তাঁর বাবা-মা জলপাইগুড়ি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। জয়ন্তর বোন অনিমার সামনে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। বাবা কলেন রায় কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। মাত্র দেড় বিঘে জমি রয়েছে কলেনবাবুর। তাতে ধানের চাষ করনে। জয়ন্ত বলেন, "ব্যাঙ্ক থেকে মোট দেড় লক্ষ টাকা ঋণ নেওয়া আছে। কী করে শোধ করব তা বুঝতেই পারছি না। ঝড়ের দিন জখম বাবা ও মাকে স্থানীয়রা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে।" একটু পরে হাসপাতালে যাবেন ও রাতে সেখানেই থাকতে হবে, জানালেন তাপস।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিণতিতে দিন-রাতের ঘুম উধাও হয়ে গিয়েছে বার্নিশ কালীবাড়ি এলাকার বাসিন্দাদের। কবে যে মাথার ওপর চাল বা ছাদ হবে তা ভাবতে ভাবতে দিন গড়িয়ে যাচ্ছে বাসিন্দাদের। গ্রামে ঢোকার আগে বড় রাস্তার পাশেই বাড়ি সুশীল রায়ের। তার স্ত্রী কল্পনা রায় মুদিখানা দোকান চালাতেন। সুশীলবাবু ও কল্পনাদেবীর বড় ছেলে বিশু রায় ও ছোট ছেলে শিবু রায়। ঘটনায় জখম কল্পনা দেবী ময়নাগুড়ি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। মঙ্গলবার ছাড়া পেয়েছেন হাসপাতাল থেকে।
আরও পড়ুন- Premium: এখনও দগদগে বীভৎস স্মৃতি! ব্ল্যাকবোর্ডে গুলির গর্ত মনে করাচ্ছে অসহনীয় ‘যন্ত্রণা’র কালো দিন
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে কল্পনা রায় বলেন, "আমি রবিবার বিকেলে সবে দোকান থেকে ঘরে এসেছি। নাতনিকে কোলে নিয়েছি। তার মধ্যে কোথা থেকে সোঁ সোঁ শব্দে ঝড় এসে সব লণ্ডভণ্ড করে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। এখন আমরা নিঃস্ব। সর্বস্ব খুইয়ে ফেলেছি। বাড়ির দলিল থেকে আধার-ভোটার কার্ড কোথায় যে উড়ে গিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। বিশুর কথায়, "চারিদিকে ফাঁকা মাথার ওপর শুধু ত্রিপল, রাতে ঘুমানো কি সম্ভব? ঝড়ের দাপটে আমাদের ৩ টে ছাগলও মরে গিয়েছে। পরনের পোষাকও সব উড়ে গিয়েছে। ঘরই নেই তো আবার পোষাক পরিচ্ছদ।"
আরও পড়ুন- Exclusive: ভোট আসে ভোট যায়, হাল ফেরে না বিশ্বের অন্যতম ক্ষুদ্র এই জনজাতির, আক্ষেপ ‘পদ্মশ্রী’র
গ্রামে ঢোকার রাস্তার বাঁদিকে প্রথম বাড়িটি অজিত রায়ের। বছর পঁয়ত্রিশের এই যুবকের ডেকরেটরের ব্যবসা। বিপর্যয়ের সময় ছোট্ট ছেলের কথায় খাটের তলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী অলোকা রায়। অজিত বলেন, "ত্রিপলের নীচে গরমে এভাবে আর কতদিন থাকব। রয়েছে মাথায় ঋণের বোঝা। হঠাৎ আসা ঝড় জীবনটা বদলে দিয়ে তছনছ করে দিয়েছে। কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। চোখে জল চলে আসছে। জীবনের বেঁচে থাকার সংগ্রাম যেন হঠাৎ আটকে গেল।" সেদিন রাতে ডেকরেটর অ্যাসোসিয়েশনকে বলে এলাকায় জেনারেটর বসিয়ে আলোর ব্যবস্থা করেছেন অজিত রায়।
কালীবাড়ি পঞ্চায়েত সদস্য জগদীশ রায় বলেন, "কাত পাড়া, বাসুনিয়া, কালীবাড়ি, কলোনি, ঘাঁটিপাড়ার প্রায় ৩০০ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রশাসন ত্রিপল, মশারি, বাসন, স্টোভ, চাল, ডাল, খাবার দিচ্ছে। তবে মাথার ওপর ছাদের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। বৃষ্টি হলে নিঃস্ব মানুষগুলো আরও অসহায় হয়ে পড়বে। করলা, ভুট্টা, ধান, পাট, লঙ্কা চাষের জমি নষ্ট হয়েছে। শ'য়ে শ'য়ে গাছ উপড়ে গিয়েছে। আমি যতটা সম্ভব মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছি।"
বার্নিশ (Barnish) কালীনগর ধংসস্তুপে পরিণত। প্রায় ৩৫-৪০ বাড়ি একেবারে মাটিতে মিশে গিয়েছে। এখানকার সকলের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। কিছু ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য মিললেও গ্রাম যে কবে পুরনো ছন্দে ফিরবে তা এখনই হলফ করে বলা যায় না। তারওপর অনেকেই ব্যাঙ্ক থেকে হাজার হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনার বইপত্র উড়ে গিয়েছে। নেই কারও পোষাক পরিচ্ছদ। এদিকে মাথায় বোঝার ওপর বোঝা। জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে হার না মানা লোকগুলো যেন ঝড়ের কাছে পরাস্ত।