Advertisment

Exclusive: পড়ুয়া ০-অধ্যাপক ২, পড়ুয়া ১-অধ্যাপক ৩, বাংলার বহু কলেজের ভয়ঙ্কর অবস্থায় প্রশ্নের মুখে উচ্চশিক্ষা

উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ টাকার অপচয় চলছে কয়েক বছর ধরেই। কারও কোনও হেলদোল নেই।

author-image
Joyprakash Das
New Update
In many colleges of West Bengal number of professors is more than the students , বাংলার বহু কলেজে পড়ুয়ার থেকে অধ্যাপকের সংখ্যা বেশি হতশ্রী উচ্চশিক্ষার অবস্থা

নীতি-পরিকল্পনার অভাবের জের?

বেহাল উচ্চশিক্ষা! পর্ব-১:

Advertisment

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজ্যপাল ও সরকারের মধ্যে চরম সংঘাত চলছে। এদিকে উচ্চশিক্ষায় লক্ষ লক্ষ টাকা রীতিমতো রসাতলে যাচ্ছে বলে মনে করছে শিক্ষামহল। ভাবুন, প্রতিমাসে বেতন পাচ্ছেন ১ লক্ষ ৮০-৯০ হাজার টাকা। আরেকদল পাচ্ছেন কম-বেশি ১ লক্ষ টাকা করে। বলতে গেলে তেমন কোনও কাজই করতে হয় না। শুধু যাওয়া আর আসা। কোথাও পড়ুয়া শূন্য, আবার কোথাও ছাত্র সংখ্যা হাতে গোনা। ক্লাস যা নিতে হয়, তা শুনলে চমকে যাবেন। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ টাকার অপচয় চলছে কয়েক বছর ধরেই। কারও কোনও হেলদোল নেই।

শিক্ষক দিবস নিয়ে বাংলায় নয়া বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকে পালন করেছেন দিনটি আবার বাঙালি সংগঠনগুলো এর বিরোধিতা করছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব তো শিক্ষক দিবসে বক্তব্য রাখতে, টুইট করতেই ব্যস্ত। বাঙালি আজ যা ভাবে, ভারত তা কাল ভাবে। এই ভাবনা যদি সত্যি হয়, তাহলে ভারত থেকে অর্থনীতি (economics) বিষয়টাই উঠে যাবে, তারপরেই উঠে যাবে কমার্স। রাজ্যের কয়েকটি কলেজের পরিসংখ্যান দেখলেই উচ্চশিক্ষার কঙ্কালসার চেহারা বেরিয়ে আসবে। অধ্যাপকদের একাংশ বলছেন, পড়াশুনার নামে উচ্চশিক্ষায় লক্ষ লক্ষ টাকা যেন 'উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ' চলছে। চূড়ান্ত অপচয় বললেও মনে হয়, কম বলা হবে।

বীরভূমের বোলপুর এবং লাভপুরের শম্ভুনাথ কলেজ এবং পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার চন্দ্রপুর কলেজে ইকোনমিক্স ও কমার্সের হাল-হকিকত জানতে তিন কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধি। তাঁদের কথাতেই উঠে এসেছে ভয়ংকর তথ্য। তিনজন অধ্যক্ষ নিজেরাও হতাশ। লক্ষ লক্ষ টাকা যে এভাবেও ধ্বংস করা যায়, তার মডেল হতে পারে এই উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা।

বোলপুর কলেজের অধ্যক্ষ ড. নুরশাদ আলি বলেন, 'ইকোনমিক্স ও কমার্সে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তেই চাইছে না। গত ১৫-২০ বছর ধরে এই ঘটনা ঘটছে। আমাদের কলেজে ইকোনমিক্সে ২৪ জনের মধ্যে একজন ভর্তি হয়েছে। কমার্সে ৫০ জনের মধ্যে ভর্তি হয়েছে ১৫ জন। ইকোনমিক্সে ৩ জন অধ্যাপক ও কমার্সে ৩ জন অধ্যাপক আছেন। ইকোনমিক্সে ৩ জনই অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর।' একজন অনার্সের পড়ুয়ার জন্য তিন জন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর! গড় হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, মাসে ৩ জনের মোট বেতন প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ টাকা। বছরে প্রায় ৬৬ লক্ষ টাকা। সেই পড়ুয়া যদি মাঝ পথে ড্রপআউট হয়ে যায়,তাহলে তো কেল্লাফতে।

আরও পড়ুন- সংঘাত চরমে, রাজ্যপাল কথা না শুনলে ‘আর্থিক অবরোধ’ রাজভবনের সামনে ধর্না! চরম হুঁশিয়ারি মমতার

বীরভূমের পাশের জেলা পূর্ব বর্ধমানের চন্দ্রপুর কলেজের অধ্যক্ষ কার্তিক সামন্তেরও কথা হয়েছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধির সঙ্গে। এখানে ইকোনমিক্স ও কমার্স দু'টো বিষয়ের দশাই খারাপ। ড. কার্তিক সামন্ত বলেন, 'আমার কলেজে কমার্সে বর্তমানে আড়াই জন শিক্ষক। দু'জন ফুল টাইম শিক্ষক। তারমধ্যে একজন অ্যাসোসিয়েট, একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। আরেকজন চুক্তি ভিত্তিক। রয়েছে আড়াইজন ছাত্র! অর্থাৎ নিয়মিত কলেজ আসে দু'জন। মোটামুটি এরকমই চলছে গত ১০-১৫ বছর ধরে। আমাদের কলেজে ইকোনমিক্সে শূন্য। একজনও ভর্তি হয়নি। ইকোনমিক্সে একজন অধ্যাপক আছেন। তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর।'

হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১২ লক্ষ টাকা বছরে ইকোনমিক্সের অধ্যাপক পান। কমার্সে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা খরচ হয় আড়াই জন ছাত্রকে পড়ানোর জন্য। ২ জন নিয়মিত কলেজ আসেন। অর্থাৎ দুই বিভাগে অধ্যাপকরা প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার ওপর বছরে বেতন নিচ্ছেন। গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেন কার্তিক সামন্ত। সেই কারণেই বেছে নিয়েছিলেন কাটোয়ার চন্দ্রপুরা কলেজ। কার্তিকবাবুর প্রশ্ন, 'ভর্তি হওয়ার পর অন্য আরেকটা ডিগ্রির জন্য পড়ছে ছাত্ররা। ফলে কোনওটাই হয় না।'

এবার আসা যাক বীরভূমের লাভপুর কলেজে। সেখানে তো চরম দুর্দশা ইকোনমিক্স অনার্সে। কলেজের অধ্যক্ষ ড. নিশীথ চক্রবর্তী বলেন, 'দুজন ইকোনমিক্সের ফুল টাইম অধ্যাপক আছেন। কিন্তু, অনার্সে একজনও ছাত্র নেই। পাসকোর্সে ৫-৬ জন আছে। তা-ও ছেড়ে দেব, ছেড়ে দেব করছে। বিগত কয়েক বছর ধরে এই অবস্থা চলছে। একজন অ্যাসোসিয়েট, একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর।' গড় হিসেব অনুযায়ী এই কলেজে ইকোনমিক্সের দুই অধ্যাপকের মাসে মোট বেতন প্রায় ৩ লক্ষ টাকা। বছরে ৩৬ লক্ষ টাকা, আসি-যাই, বেতন পাই। শিক্ষামহলের বক্তব্য, একদিনে এই দুরাবস্থা হয়নি। উচ্চশিক্ষা দফতরের কোনও উদ্যোগই নেই। নেই, সঠিক কোনও পরিকল্পনা। অহেতুক অর্থ অপচয় হচ্ছে।'

কেন এই দুরাবস্থা, তার নানা কারণ রয়েছে বলে মনে করছে শিক্ষামহল। কিন্তু বসে বসে জনসাধারণের অর্থ নষ্ট হওয়ায় বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বোলপুর কলেজের অধ্যক্ষ নুরশাদ আলির বক্তব্য, 'চাকরি না-থাকলে পড়বে কেন? বাঙালি মানসিকতা শিক্ষকের চাকরি করবে। চাকরি ছাড়া আর কিছু করব না। সেক্ষেত্রে শিক্ষকতার চাকরি আদর্শ। দায়দায়িত্ব নেই, প্রচুর বেতন। সেটাই বন্ধ হয়ে রয়েছে। কমার্সে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় ভর্তি হচ্ছে, অবাঙালিদের কমার্সে পড়ার ঝোঁক রয়েছে, বাঙালিদের সেটা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া পাচ্ছে না। এটা দীর্ঘ দিনের সমস্যা।' তাঁর মতে সমস্যা অনেক। তিনি মনে করেন, 'ইকোনমিক্স পড়লে ম্যাথামেটিক্স ব্যাকগ্রাউন্ড চাই। উচ্চমধ্যমিকে ম্যাথামেটিক্স পড়ে আসতে হবে। স্নাতকে ইকোনমিক্সে ম্যাথ রয়েছে। যার ম্যাথামেটিক্স ব্যাকগ্রাউন্ড আছে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। অঙ্ক ছাড়া পড়তে পারবে না। পরিশ্রম করতে হবে, মেরিট দরকার, আবার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। বিভিন্ন সরকারি দফতরে চাকরির সুযোগ কমে গিয়েছে। আমাদের কলেজে জোর করে কম্বিনেশনে রাখা হয়েছে জিওগ্রাফি পড়লে ইকোনমিক্স পড়তে হবে। সেখানে ২৫-৩০ জন আছে।'

শিক্ষামহলের মতে, এসএসসি বা স্কুল সার্ভিস কমিশন চালু না-হলে, কলেজগুলোর পড়াশুনা সব শেষ হয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ নেই। নিয়মিত এসএসসির পরীক্ষা চালু রাখতে হবে। কলেজগুলোতে যে বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হচ্ছে না, সেই বিষয়ে এবারও অধ্যাপক নিয়োগ করতে চলেছে কলেজ সার্ভিস কমিশন। স্কুলে না-পড়ালে পরবর্তী ধাপে ছাত্র-ছাত্রী কোথা থেকে আসবে? প্রশ্ন তুলছে অভিজ্ঞ মহল।

West Bengal Mamata Government colleges college education
Advertisment