২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের পর আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও বঙ্গ বিজেপির ছন্নছাড়া ভাব যেন কিছুতেই কাটছে না। ইতিমধ্যে বঙ্গ বিজেপির দুই রাজ্য দফতরেই বিক্ষোভ দেখিয়েছে দলের কর্মীরা। সল্টলেকের পর রাজ্যের পুরনো দফতর ৬, মুরলি ধর সেন লেনে তো শীর্ষ নেতৃত্বের ছবি পা দিয়ে মাড়িয়ে ছেড়েছে বিক্ষোভকারীরা। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে বাংলা নিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কপালে রীতিমতো চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। গোপন আঁতাত করে বাংলায় বাইনারি পলিটিক্সের পরিস্থিতি তৈরি করছে বিজেপি ও তৃণমূল, বিরোধীদের এই অভিযোগ তো আছেই। ছন্নছাড়া বঙ্গ বিজেপি তার কতটা ফায়দা পাবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের পর এখনও অবধি এই রাজ্যে আসার সাহস দেখাননি বিজেপির তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কৈলাশ বিজয়বর্গীয়। পশ্চিমবঙ্গ বলে দেশের কোনও রাজ্য আছে কি না তা সম্ভবত বিজেপির এই শীর্ষ নেতৃত্ব ভুলেই গিয়েছেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। বাংলা দখলের ভাষণ দিয়ে এখন নিজের রাজ্যেই আবদ্ধ কৈলাশ। বিজয়বর্গীয়র বিরুদ্ধেও তখন কলকাতা জুড়ে পোস্টার পড়েছিল। এবারও কেন্দ্রীয় নেতা অমিত মালব্য়র বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন দলের কর্মীরা। তাছাড়া রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, সাংগঠনিক সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী, সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়রা বাদ যাননি ক্ষোভের আঁচ থেকে। কেন আড়াই বছর ধরেও দলের কর্মীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ থেকে গিয়েছে? তা নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
গত বিধানসভা নির্বাচনের পর বঙ্গ বিজেপি অভিযোগ তুলেছিল, তৃণমূল কংগ্রেস তাঁদের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ওপর অত্যাচার করছে। বিজেপির নীচুতলার কর্মীরা উল্টে দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অভিযোগ করেছিলেন। বিপদে পড়লেও কর্মীদের ফোন ধরেননি অধিকাংশ নেতা, অনেকের বাড়িঘর ভাঙচুর হয়েছে- ক্ষতিপূরণ পাননি, দল পাশে থাকেনি, চিকিৎসা করাতে পারেননি অর্থের অভাবে। দিনের পর দিন বাড়িতে ঢুকতে পারেননি। কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, দল করতে গিয়ে পরিবারকে বিপদে ফেলেছি কিন্তু দলের নেতারা কোনও পাত্তা দেননি।
আরও পড়ুন- ‘বিশ্বভারতীর সোনালী অতীত ফিরছে’, সমালোচকদের ‘মোক্ষম’ জবাব কর্তৃপক্ষের
পরবর্তীতে বিভিন্ন জেলা নেতৃত্বের একটা বড় অংশ পদত্যাগ করেছেন। শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েই তাঁরা পদত্যাগ করেছিলেন। জেলায় জেলায় কমিটি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এমনকী জেলা সভাপতিদের নিয়োগ নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই। মোদ্দা কথা বিজেপির একাংশের অভিযোগ, রাজ্য থেকে জেলাগুলিতে যাঁরা দলের দায়িত্বে রয়েছেন তাঁদের অনেকেই দলের ক্ষতি করছেন। দলের প্রকৃত কর্মীদের বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে অশনি সংকেত দেখছে দলের একটা বড় অংশ।
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির অর্ধেক প্রার্থীই ছিলেন তৃণমূল থেকে আসা। কয়েকজন ছিলেন প্রবাসী বিজেপি নেতা। তাঁদের কেউ কেউ আবার মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্ন দেখেছিলেন বলে ঘনিষ্ঠ মহলে দাবি করেছিলেন। ফল ঘোষণা হতেই দেখা গেল তাঁরা বেশিরভাগই গোহারা হেরেছেন। বঙ্গ বিজেপির আদি নেতাদের অনেককেই টিকিট দেয়নি দল। তখন রাজ্য শীর্ষ নেতৃত্বের ওই অংশের বক্তব্য় ছিল, চোখের জল বৃথা যাবে না। প্রার্থী তালিকা ঘোষণার দিন অনেকেই আড়ালে হাউ-হাউ করে কান্না করেছিল বলেই খবর। তাঁদের অনেককেই পরে রাজ্য কমিটি থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিজেপির রাজ্য ও জেলা তথা স্থানীয় স্তরের অনেকেই রাজনীতি থেকে বসে গিয়েছেন। সায়ন্তন বসু, রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো অনেককেই এখন বিজেপির কোনও কর্মসূচিতে দেখা যায় না। অন্য দিকে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী দত্তরা বিজেপির মায়া ত্যাগ করে ২০২১ নির্বাচনের পরেই তৃণমূলে ফিরে গিয়েছেন। টলিউডের অধিকাংশ শিল্পীই এখন ঘাসফুল শিবিরে গিয়ে ভিড়েছেন। রাজনৈতিক মহলের মতে, মাঝখান থেকে বিজেপির আদি সক্রিয় নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই এখনও বসে রয়েছেন। যাঁরা রাজনীতিতে আছেন তাঁদের দায়িত্ব দেয়নি দল। এই সব কারণেই ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক অনুপম হাজরাও একাধিকবার বসে যাওয়া কর্মীদের ফিরিয়ে আনার জন্য মুখ খুলেছেন। রাজনৈতিক মহলের মতে, এখনও অবধি কাজের কাজ তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। লোকসভা নির্বাচনের আগে বঙ্গ বিজেপির এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব। তবে দলের একাংশ মনে করে, রাজ্যে বিজেপির কোন্দল নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের কোনও হেলদোল নেই। বিজেপি তৃণমূলের লড়াইয়ে গোপন আঁতাতই দেখছে সিপিএম। ইডি, সিবিআই এখানে বিজেপির হয়ে কাজ করছে সেই অভিযোগ তো আছেই। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কী ইডি, সিবিআইয়ের তৎপরতায় এখানে বিজেপি ক্ষমতায় চলে আসবে? এরাজ্যে বাইনারি পলিটিক্স চলছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। কিন্তু সেক্ষেত্রে বড় ফায়দা নিতে তৃণমূলের থেকে বিজেপি কি ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে? এই প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে।