স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর রহস্যমৃত্যুতে একাধিক প্রশ্ন উঠছে। ইতিমধ্যে এই ঘটনায় পুলিশ সৌরভ চক্রবর্তী, মনতোষ ঘোষ ও দীপশেখর দত্তকে গ্রেফতার করেছে। কলকাতা পুলিশ কমিশনারের দাবি, স্বপ্নদীপের মৃত্যুর সর্বোচ্চ পর্যায়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু, কেন এমন ঘটনা ঘটল? স্বপ্নদীপের রহস্যমৃত্যুর অন্তর্তদন্তে উঠে এসেছে নানা প্রশ্ন।
তিন জন গ্রেফতার হলেও আদৌ এই ঘটনার পিছনে কারা কারা রয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের সিস্টেম কতটা দায়ী? কী এমন ঘটল যে একজন ছাত্রের অকালে প্রাণ চলে গেল? স্বপ্নদীপের মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষের কী ভূমিকা ছিল? প্রমাণ লোপাটের কি কোনও চেষ্টা হয়েছিল? এমন একাধিক বিষয় উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, প্রাক্তনীদের একাংশের নানা প্রশ্ন রয়েছে স্বপ্নদীপ কুন্ডুর রহস্যমৃত্যু ঘিরে। সেই সব প্রশ্নের জবাব এখনও অধরা।
স্বপ্নদীপের মৃত্যুর তদন্তে তিন জন গ্রেফতার হলেও প্রাক্তনীদের ওই অংশের মতে, এই ঘটনার হাত বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বেআইনি ভাবে প্রায় ৫০ জন প্রাক্তনী এই হস্টেলগুলোতে থাকে। সঙ্গে বহিরাগতদের থাকার অভিযোগও উঠছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ কোনও পদক্ষেপ নেয় না-বলেই অভিযোগ। ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায়ের ভূমিকা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। এদিকে রজত রায়কে ফোন করা হলেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন- স্বপ্নদীপের মৃত্যু! ‘উপাচার্যদের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়ে কালি’, বললেন অধ্যাপক অভিজিৎ চক্রবর্তী
যেহেতু বস্ত্রহীন অবস্থায় স্বপ্নদীপকে উদ্ধার করা হয়েছে সেক্ষেত্রে সমকামী তত্বে সিলমোহর দিতে উঠেপড়ে লেগেছে কেউ কেউ। সূত্রের খবর, র্যাগিং পর্ব শুরু হয়েছিল বাংলা ডিপার্টমেন্ট থেকে। সেখানে এক সিনিয়র ছাত্র ও এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব দিয়েই স্বপ্নদীপের সঙ্গে র্যাগিংয়ের সূত্রপাত হয়েছিল বলে ওই সূত্রের দাবি। যদিও ওই দুজনের পরিচয় জানা যায়নি। তাঁকে শারীরিক অঙ্গ নিয়ে অশালীন প্রশ্ন করা হয়েছিল। ভয়ে কাঁপতে থাকে সদ্য ভর্তি হওয়া মফস্বলের ছাত্রটি। কী উত্তর দেবে ভেবে কূল পাচ্ছিল না।
জবাব না দেওয়ায় শুনতে হয়েছে গালমন্দ। স্বপ্নদীপ আদৌ কী, তা নিয়েই ঠাট্টা করা হয়েছিল বলে ওই সূত্রের দাবি। একথা স্বপ্নদীপ হস্টেলে বলতেই দু'দিন ধরে তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-মশকরা চলতে থাকে। এখান থেকেই সমকামী তত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া বলে ওই সূত্রের দাবি। সূত্রের খবর, এভাবেই ট্রমাটাইজ হয়ে যায় স্বপ্নদীপ। এই ঘটনায় জড়িত অনেকেই গা-ঢাকা দিয়েছে বলে খবর।
আরও পড়ুন- ‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে, দেওয়ালেই ঘাম মোছা’, স্বপ্নদীপের হস্টেলযাপনের দুই ভয়ঙ্কর রাত!
স্বপ্নদীপকে কেপিসি হাসপতালে নিয়ে যাওয়ার পর কাদের মদতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি? উঠছে সেই প্রশ্নও। প্রাক্তনীদের ওই অংশের দাবি, জল দিয়ে রক্ত কি ধুয়ে ফেলা হয়েছিল? যদি তা করা হয় কার বা কাদের নির্দেশে কেন এই কাণ্ড করা হয়েছিল? এভাবেই কি প্রমাণ লোপাট করার প্রাথমিক চেষ্টা করা হয়? সূত্রের খবর, ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায় ঘটনার পর থেকে ভোর পর্যন্ত কেপিসি হাসপাতালে ছিলেন। ঘটনার পর কি তিনি হস্টেলে এসে খোঁজ নিয়েছিলেন কেন এমন ঘটল? তাঁর কি ভূমিকা ছিল? হস্টেল সুপারের কি ভূমিকা? তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
মোবাইলের যুগে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কারও মৃত্যু হলে সেই লাইভ ভিডিও পর্যন্ত ভাইরাল হয়ে যায়। এখনও পর্যন্ত স্বপ্নদীপের মাটিতে পড়ে থাকা কোনও স্টিল বা ভিডিও প্রকাশ্যে আসেনি। তাহলে কি কেউ সেদিন রাতের কোনও ছবি বা ভিডিও তোলেনি? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও প্রাক্তনীরা মনে করছেন, কারও না-কারও কাছে এই ভিডিও বা ছবি থাকতে পারে। তা সামনে এলে তদন্তের গতি কিন্তু বাড়তে পারে।
আরও পড়ুন- ‘ইন্ট্রো’র নামে মাত্রাছাড়া ‘মানসিক অত্যাচার’! যাদবপুর-কাণ্ডে ধৃত আরও ২
সিসিটিভি খোলা বা বন্ধ করা নিয়ে বড় অভিযোগ করেছেন প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। আরেক প্রাক্তন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস এই প্রশ্নের কোনও জবাব দেননি। সিসিটিভি বসাতে না-দেওয়ার যুক্তি মানতে চান না এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও প্রাক্তনীদের বড় অংশ। অপরাধ দমনে যেখানে সর্বত্র সিসিটিভির প্রচলন, সেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কী এমন কর্মকাণ্ড হয়, যে সিসিটিভি বসানো যাবে না? প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। সর্বোপরি যাদবপুর, কলকাতার রাস্তায় এখনও মোমবাতি মিছিল চোখে পড়ছে না! কটাক্ষ পর্যবেক্ষক মহলের।
আরও পড়ুন- স্বপ্নদীপ-মৃত্যুতে ধৃত মনোতোষ, যাদবপুরের মেধাবী ছাত্রের গ্রেফতারিতে কী বললেন বাবা-মা?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২০ জনের অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি রয়েছে। এখানে সবাই উচ্চপদস্থ আধিকারিক বা অধ্যাপক। তাঁদেরই বা কী ভূমিকা রয়েছে? এক্ষেত্রেও বড়সড় প্রশ্ন রয়েছে। অধ্যাপক সংগঠন থেকে ছাত্র সংগঠন, স্বপ্নদীপের অকাল মৃত্যু নিয়ে তাঁদের কারও কারও ভূমিকায় পর্যবেক্ষক মহল সন্দিহান। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের আলাদা জায়গায় রাখার নিয়ম থাকলেও কেন অতিথি প্রথা চালু রয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে? উঠছে সেই প্রশ্ন। কেচো খুঁড়তে গেলে কেউটে ধরা পড়বে! মনে করছে অভিজ্ঞমহল।