Jaynagarer Moa: শীতকাল এলেই মোয়া নিয়ে চর্চা বেড়ে যায়। নলেন গুড়ের পাকে তৈরি সুমিষ্ট মোয়ার স্বাদ ও গন্ধ এককথায় অতুলনীয়। আর এই মোয়ার আঁতুরঘর হল দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর, বহড়ু এলাকা। 'জয়নগরের মোয়া'র (Jaynagarer Moa) রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভিনরাজ্য এমনকী বিদেশেও সমাদৃত। তবে আপনি কী জানেন এই মোয়ার প্রথম সৃষ্টি কিন্তু জয়নগরে নয়। সংলগ্ল বহড়ু গ্রামেই মোয়ার আবিষ্কার হয়। সেকালে জয়নগরেই হাট বসতো। তাই অখ্যাত বহড়ুর চেয়ে 'জয়নগরের মোয়া'র নাম সহজেই লোকমুখে ছড়াবে বলে মনে করতেন কারবারিরা। ক্রমেই জয়নগরই হয়ে ওঠে মোয়ার পীঠস্থান। তবে মোয়ার আবিষ্কারের পিছনে রয়েছে একগুচ্ছ সোনালী ইতিহাস। কথিত আছে, স্বয়ং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (Chaitanya Mahaprabhu) সুখ্যাতি করেছিলেন এই জয়নগরের মোয়ার। তারপর থেকেই জয়নগরের মোয়া দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।
কলকাতা শহর লাগোয়া জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগনা। এই জেলারই এক প্রান্তে রয়েছে জয়নগর। মোয়া জয়নগরের বলা হলেও আদতে তা কিন্তু বহড়ুর (Baharu)। রেলপথে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায় জয়নগর স্টেশনের আগেই পরে বহড়ু স্টেশন। এলাকায় জনশ্রুতি, জয়নগরের মোয়ার আবিষ্কর্তা হলেন জয়নগর শহর নিকটবর্তী এলাকার বাসিন্দা 'যামিনীবুড়ো'। এই যামিনী বুড়ো একটি অনুষ্ঠানে নিজের ক্ষেতে চাষ করা কনকচূড় ধানের খই ও তার সঙ্গে নলেন গুড় মিশিয়ে মোয়া তৈরি করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানেই নাকি এসেছিলেন স্বয়ং মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব। তিনি সেই মোয়া খেয়ে অত্যন্ত সুখ্যাতি করেছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেবের সুখ্যাতির পর থেকেই জয়নগরের মোয়া বিশাল খ্যাতি পায়। শুরুর দিকে এটা বহড়ুর মোয়া বলেই পরিচিত ছিল। তবে বহড়ুর তুলনায় জয়নগর শহরের বেশি নাম-ডাক। সেখানেই বসতো হাট। তাই সময় যত এগিয়েছে, বহডুর কৃতিত্বে খানিকটা কোপ বসিয়েই সুস্বাদু এই মিষ্টান্ন আবিষ্কারের স্বীকৃতি কব্জা করেছে জয়নগর।
জানা যায়, ১৯২৯ সালে জনৈকে পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ওরফে বুচকিবাবু এবং নিত্যগোপাল সরকার জয়নগর শহরে মোয়া তৈরির আস্ত কারখানা এবং দোকান তৈরি করেন। স্বাধীনতার আগে থেকেই জয়নগরের মোয়া বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিল। জয়নগরের মোয়ার প্রধান উপাদান হল কনকচূড় ধানের খই, নলেন গুড় এবং গাওয়া ঘি। এছাড়াও এই মোয়া তৈরিতে ক্ষীর, পেস্তা, কাজুবাদাম, কিসমিস ও পোস্ত ব্যবহার করেন মোয়া প্রস্তুতকারকরা। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কুলপি, কাকদ্বীপ, নামখানা-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার কয়েকশো বিঘা জমিতে কনকচূড় ধানের চাষ হয়। আর এই মোয়া তৈরিতে যে নলেন গুড় লাগে তাও এই এলাকার খেজুর গাছের রস থেকেই তৈরি করা হয়। এতল্লাটের খেজুর গাছের রস অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের। গাছ থেকে রস পেড়ে তা জাল দিয়ে তৈরি হয় নলেন গুড়।
আরও পড়ুন- Success Story: হাজারো 'বাধা' দূরে ঠেলে বিরাট বিজয় বঙ্গতনয়ের! শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে কৃষক সন্তান
তবে গত কয়েক দশকে 'জয়নগরের মোয়া' তৈরির ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে কাঁচামালের জোগানের অভাব। মোয়া তৈরির প্রধান দুই উপাদান কনকচূড় ধান এবং নলেন গুড়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। কমে আসছে কনকচূড় ধানের চাষও। পাল্লা দিয়ে কমছে খেজুর গাছের সংখ্যা। আর এই সংকটের সুযোগ নিয়েই গত কয়েক দশক ধরে মোয়া তৈরিতেও রীতিমতো 'ভেজাল কারবারি'দের উৎপাত। সাধারণ নিম্নমানের খই এবং নিম্নমানের গুড় দিয়েই তৈরি হচ্ছে মোয়া। রঙিন মোড়কে মুড়ে সেটাই 'জয়নগরের মোয়া' বলে বিক্রি করছেন এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী।
আরও পড়ুন- Sundarbans: সুন্দরবনে বাম্পার পরিকল্পনা রাজ্যের, বিপজ্জনক নদীবাঁধের সংস্কারে দুরন্ত তৎপরতা!
জয়নগরের রেল স্টেশনটি 'জয়নগর মজিলপুর' বলে পরিচিত। শহর কলকাতা থেকে এই এলাকার দূরত্ব ৫০ কিলোমিটারের মতো। সকালে কলকাতা শহর থেকে জয়নগরে এসে মোয়া কিনে দুপুরেই বাড়ি ফিরতে পারেন। ফি শীতে বাইরের বহু জায়গা থেকে জয়নগরে এসে মোয়া আর নলেন গুড় কিনে নিয়ে যান অনেকে। তাই এই শীতেও ইচ্ছে করলেই কয়েক ঘণ্টার ঝটিকা সফরে ঢুঁ মারুন জয়নগরে।
রথ দেখা কলা বেচা !
দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই জয়নগর এলাকার কাছেই বেশ কয়েকটি তাক লাগানো পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। চাইলে, জয়নগরে মোয়া-গুড়-পাটালি কিনে সেই সব জায়গাতেও আপনি বেরিয়ে আসতে পারেন। বকখালি, মৌসুনী আইল্যান্ডের মতো সমুদ্র উপকূলবর্তী পর্যটনকেন্দ্রগুলিও জয়নগর থেকে বেশি দূরে নয়। তাই যদি মনে হয় জয়নগরে নেমে মোয়া কিনে একটু বেড়াতে যাবেন, সেটাও করতে পারেন অনায়াসেই। তবে এসবই করতে হবে ট্রেনের টাইমটেবিল জেনে নিয়ে।
আরও পড়ুন- Kolkata Metro: পাতালপথে নয়া ইতিহাস কলকাতা মেট্রোর, যাত্রী-স্বার্থে মারকাটারি তৎপরতা 'সুপারহিট'
জয়নগরের ইতিহাস
জয়নগর একটি প্রাচীন জনপদ। শিয়ালদহ-নামখানা রেললাইনের পশ্চিমে জয়নগর শহর ও পূর্বে মজিলপুর শহর অবস্থিত। মূলত কায়স্থ প্রধান এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠে জয়নগর। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ প্রধান মজিলপুর অপেক্ষাকৃত নতুন শহর। জয়নগর-মজিলপুর শহরটি তার সাহিত্যিক, শৈল্পিক বৈপ্লবিক, ঐতিহ্যের জন্যও সুবিদিত। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি এই এলাকার বাসিন্দাদের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। তবে কালের বিবর্তনে এখন অনেকটাই ম্রিয়মাণ অতীতের সেই সোনালী সংস্কৃতি।