স্কুলে পড়ার সময় সরকারের দেওয়া মিড-ডে মিল খেয়ে একবেলা পেট ভরত। কিন্তু কলেজে তো সে ব্যবস্থা নেই। তাই দুঃস্থ পরিবারের পড়ুয়াদের অনেককে খিদে নিয়েই ক্লাস করতে হয় দিনভর। রাজ্যের সর্বত্রই এমনই রেওয়াজ। কিন্তু বেহালার একটি কলেজে কার্যত উলটপুরাণ। এখানে শিক্ষিকাদের একাংশ নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচ করে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে আসা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রীদের জন্য ভাত-ডাল-তরকারি-ডিম-মাংসের মিড ডে মিলের ব্যবস্থা করেন। বছরভর তাঁদের উদ্যোগে পেট ভরে খায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে পড়তে আসা মেয়ের দল।
বেহালা চৌরাস্তার কাছে ডায়মন্ড হারবার রোডের একদম উপরেই বিবেকানন্দ কলেজ ফর উইমেন। কলেজ সূত্রের খবর, মিড-ডে মিল দেওয়ার উদ্যোগ প্রথমে নিয়েছিলেন অধ্যক্ষা সোমা ভট্টাচার্য। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ২০১৬ সাল থেকে প্রতিদিন কলেজের একঝাঁক দুঃস্থ পড়ুয়ার মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করতেন। এর জন্য যে অর্থ খরচ হত, তা সম্পূর্ণটাই নিজের পকেট থেকেই দিতেন অধ্যক্ষা। বেশ কয়েক বছর এমন চলার পর গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি অন্য শিক্ষিকাদের এই কাজে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন। অধ্যক্ষার ডাকে সাড়া দেন আরও সাত অধ্যাপিকা। স্থির হয়, প্রতি মাসে এই আটজন অধ্যাপিকা মিড-ডে মিলের তহবিলে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেবেন। সেই ব্যবস্থাই এখন বহাল রয়েছে।
আরও পড়ুন: নজিরবিহীন! বেথুন কলেজের ভর্তির ফর্মে প্রথম ধর্ম ‘মানবতা’, পরে হিন্দু-মুসলিম
কলেজের নিজস্ব ক্যান্টিন রয়েছে। কিন্তু শিক্ষিকাদের এই উদ্যোগ সম্পূর্ণ পৃথক। স্বপ্না রায়, রিক্তা জোয়ারদার, জয়তি ভট্টাচার্যরা জানালেন, স্কুলের তহবিল বা পরিকাঠামোর সঙ্গে মিড-ডে মিলের কোনও সম্পর্ক নেই। রিক্তার কথায়, "এই উদ্যোগটি আমাদের নিজস্ব। তাই যাবতীয় ব্যবস্থাপনা আমরা নিজেরাই করে চলেছি। কেবল টাকাপয়সার বিষয় তো নয়, রান্নার সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা, রাঁধুনি ঠিক করা, গ্যাস শেষ হয়ে গেলে ফের গ্যাস আনা - সবকিছুই আমরা হাতে হাত মিলিয়েই করি।" জয়তি বলেন, "বার্ষিক এক লক্ষ টাকার কম আয়ের পরিবার থেকে যে মেয়েরা আসে, আমরা তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পেরেছি। ছাত্রীরা প্রথমে কাগজে লিখে মিড-ডে মিলের জন্য আবেদন করে। সেই আবেদনের ভিত্তিতে ওদের নির্দিষ্ট কুপন দেওয়া হয়। ওই কুপন দেখিয়ে মেয়েরা খাবার সংগ্রহ করে।"
কী খাওয়ানো হয় মিড-ডে মিলে? মিঠু সিংহ, সুমনা দাস, তমসা চট্টোপাধ্যায়ের মতো অধ্যাপিকারা জানালেন, তাঁরা চেষ্টা করেন প্রোটিন জাতীয় খাবারের ব্যবস্থা করতে। তাই ডাল-ভাতের সঙ্গে সয়াবিন বা ডিম বেশি দেওয়া হয়। তবে মাঝেমধ্যে মাংসের ব্যবস্থাও করেন তাঁরা। তমসা বলেন, কলেজের একটি অব্যবহৃত ঘরকে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়েছে। সেখানেই রান্না হয়।
আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার ক্ষত সারিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন বিলকিস
বেহালার ওই কলেজে স্থানীয় মেয়েরা যেমন ভর্তি হয়, তেমনই বিপুল সংখ্যক ছাত্রী আসে দক্ষিণ ২৪ পরগণার দূরদূরান্ত থেকে। অধ্য়ক্ষার কথায়, "কেউ ডায়মন্ড হারবার থেকে আসে, কেউ আসে ফলতা থেকে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে কিছু মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় ওদের। আর্থিক সংকট তো আছেই, পাশাপাশি দূরত্বটাও অনেক। বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা দিনভর না খেয়ে থাকবে নাকি! তাই সীমিত সামর্থ্যে আমাদের এই উদ্যোগ।"
রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই মিড-ডে মিল নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। এই কলেজের ছবিটা অবশ্য একদমই আলাদা। এক শিক্ষিকার কথায়, "ওরা তো আমাদের মেয়ের মতো। তাই সাধ্যের মতো যতটুকু ভাল চাল, ভাল তেল পারি, তাই দিয়েই রান্না হয়।"
শিক্ষিকাদের এমন প্রচেষ্টায় মুগ্ধ শিক্ষামহলের একাংশও। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, "এঁরাই প্রকৃত শিক্ষিকা। এমন মানুষরা আছেন বলেই এখন শিক্ষাব্যবস্থাটা টিঁকে আছে।"