এমাসের ১১ তারিখে এক সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যের বিজেপি নেতা মুকুুুল রায় ঘোষণা করেন, সম্প্রতি এনআরএস মেডিকেল কলেজে রোগী মৃত্যুর জেরে ডাঃ পরিবহ মুখোপাধ্যায়ের উপর মারাত্মক হামলা তৃণমূলের নেতৃত্বেই হয়েছে। শুধু তাই নয়, “এই ঘটনায় একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে গার্ড করতে চাইছে তৃণমূল,” বলেন তিনি। নিগ্রহকারীদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না, সেদিন সেই প্রশ্নও তোলেন মুকুল রায়। ঘটনাচক্রে, যে রোগীর মৃত্যু হয়, তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য, যারা হাসপাতাল চত্বরে হামলা চালায়, তারাও তাই বলেই অনুমান।
এর অব্যবহিত পরেই ঘটে আরেক দুর্ঘটনা। সোমবার রাতে শহরের কেন্দ্রস্থলে এক্সাইড মোড়ে আক্রান্ত হন শহরের এক জনপ্রিয় মডেল-অভিনেত্রী। আক্রমণের বিস্তারিত বিবরণ ভিডিও সমেত ফেসবুকে পোস্ট করেন তিনি। ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় সাতজন যুবককে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সকলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য।
আরও পড়ুন- বেশি ভালবেসে ভুল করেছি, ‘উপলব্ধি’ মমতার
পরপর ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা নিয়েই এবার মুখ খুললেন এই শহর অথবা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত একদল বিশিষ্ট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিক। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে তাঁরা জানালেন, গোটা সম্প্রদায় "মর্মাহত এবং স্তম্ভিত", এবং তাঁর সরকারের তথাকথিত 'সংখ্যালঘু তোষণ' যেন দোষীদের শাস্তির পথে বাধা সৃষ্টি না করে।
চিঠিটি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক তথা সমাজকর্মী মুদর পাথেরিয়া। তাঁর বক্তব্য, "সব দেখেশুনে ডিসগাসটেড লাগছিল। যেন আমাদের কোনো ভয়েস নেই। এতদিন ধরে ভেবে এসেছি আমরা কী করতে পারি, আমরা তো কিছুই পারি না। কিন্তু এই ঘটনাগুলো তো আমাদের সঙ্গেও ঘটতে পারত। ধর্ম দেখে তো কেউ ডাক্তারদের মারধর করে নি। আমরা চাই, এনআরএস হাসপাতালে যারা হামলা করেছিল, তারাও গ্রেফতার হোক।" মুদরেরই মস্তিস্কপ্রসূত এই চিঠি, যা মেইল মারফতও পাঠানো হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে।
আরও পড়ুন- ‘মমতাকে ধীরে ধীরে ব্যথা দেব’
গুরগাঁওয়ের বাসিন্দা আকিল বসরাইয়ের শিক্ষা এবং কর্মজীবনের অনেকটাই কেটেছে কলকাতায়। চিঠিতে সই করেছেন তিনিও। ফোনে বললেন, "আমার মনে আছে, ১৯৬৪ সালে আমার বয়ঃসন্ধির পার্টি বাতিল করতে হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য। কিন্তু তারপর থেকে কলকাতায় কোনোদিন দাঙ্গা দেখি নি সেরকম ভাবে। এখন ভয় হচ্ছে, সেই আবহ ফের একবার না তৈরি হয়। প্রথমেই বাধা না দিলে এই বিদ্বেষ ছড়াবেই"।
চিঠির ভাবনা মুদরের মাথায় আসে যাঁর কথা শুনে, সেই হেনা নফিস পেশায় নিউট্রিশনিস্ট, ভালো বাংলায় পুষ্টিবিজ্ঞানী। তাঁর বক্তব্য, "আমার চেম্বারে পেশেন্টদের কেউ কেউ ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করছেন, 'আমরা' অর্থাৎ মুসলিমরা ভয় পাচ্ছি কিনা। কেন ভয় পাব? ছোটবেলা থেকে এখানে আছি, কেউ কখনও একথা জিজ্ঞেস করে নি। কিন্তু এখন দেখছি, ছোটবেলা থেকে যেসব মানুষের সঙ্গে বড় হয়েছি, তারাই কেমন পাল্টে যাচ্ছে। ভারতের সমস্যা ধর্ম নয়, সমস্যাটা হলো শিক্ষা এবং সচেতনতার অভাব, এবং দারিদ্র। খুব সামান্য টাকার বিনিময়ে আপনি নানারকম দুষ্কর্ম করার লোক পেয়ে যাবেন, হিন্দু হোন বা মুসলিম। "
আরও পড়ুন- ‘বন্দে মাতরম’ ইসলামবিরোধী, সমাজবাদী সাংসদের মন্তব্যে উত্তাল লোকসভা
এই আবহে এই চিঠি কি 'সংখ্যালঘু তোষণের' তত্ত্বকেই নিশ্চিত করছে না? হেনা বলছেন, কিছু মহলে চিঠিটির কিঞ্চিৎ বিকৃত ব্যাখ্যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। আকিলের কথায়, "এই চিঠি আদৌ সিএম পড়বেন কিনা জানি না। কিন্তু একজনের মনেও যদি এর ছাপ পড়ে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যদি বোঝে যে হিংসার ফল কখনওই শুভ হয় না, তাহলেও আমি খুশি। কখনও কখনও নিজের বিবেকের কথাও শুনতে হয়, যে যাই বলুক বা বিকৃত করুক। এ তো আর দাবা নয় যে ভেবে, মেপে চাল দেব।"
হেনার পরিবার খুব খুশি নন তাঁর এই প্রকাশ্য অবস্থান নিয়ে। ক্যাফেতে বা ঘরোয়া আড্ডায় বলা এক, খোলাখুলি চিঠিতে বলা আর এক। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে বলছেন, এই চিঠি কোনোভাবেই "রাজনৈতিক" নয়। চিঠিতে শুধু সমস্যার কথা বলা হয় নি, সমাধানের পথও দেখানো হয়েছে। মূলত মুসলিম তরুণদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পথ। সেই পরামর্শ কতটা কার্যকরী করা যায়, তা সময় বলবে।