Anuradha Talwar: লোকসভা ভোটে (Lok Sabha Election 2024) ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াই জারি। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তেও নারাজ। ইতিমধ্যে সন্দেশখালির (Sandeshkhali) আন্দোলনে রাজ্য-রাজনীতি তোলপাড়। সেখানেও অন্যতম ইস্যু জমি। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন রাজ্যে পরিবর্তনের পথ দেখিয়েছিল। কিন্তু সরকারের পরিবর্তন ঘটলেও জমিজট সমস্যা থেকেই গিয়েছে সেই তিমিরে।
রাজ্যে পালাবদল ঘটে গিয়েছে প্রায় ১৩ বছর আগে। তবু জমি নিয়ে কেলেঙ্কারি কোনও অংশে কমেনি। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা বেড়েছে কয়েকগুণ। দীর্ঘদিন ধরে গণ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সমাজসেবী অনুরাধা তলোয়ার (Anuradha Talwar)। দিল্লি জন্মস্থান হলেও বাংলার খেটে-খাওয়া মানুষের জীবন-জীবিকার লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত গণ আন্দোলনের এই নেত্রী। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি রক্ষার আন্দোলন হোক বা চা বাগান, দেউচা পাঁচামির জমি বাঁচানোর সংগ্রামের সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত করেছেন তিনি।
এমনকী তাঁদের সংগঠন উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি-সহ বিস্তারিত এলাকার জমি সমস্যা নিয়েও কাজ করে চলেছে নিরন্তর। কিন্তু গণআন্দোলন কেন আজ গভীর সমস্যায়, জমি সমস্যার স্বরূপ সহ নানা বিষয় নিয়ে একান্তে অনুরাধা তলোয়ার কথা বলেছেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধির সঙ্গে।
প্রশ্ন- আপনি বামফ্রন্টের আমল দেখেছেন, গণ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তৃণমূলের জমানাও দেখছেন। কোথাও কি মনে হচ্ছে না অধিকার আদায়ে মানুষের আন্দোলন ধাক্কা খাচ্ছে?
অনুরাধা তলোয়ার- বামফ্রন্টের চলে যাওয়ার প্রায় ১৩ বছর হতে চলল। এই সময়ের মধ্যে দু'টো বড় ঘটনা ঘটেছে। কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে BJP। অর্থনৈতিকভাবে মানুষ বড় ধাক্কা খেয়েছে কোভিড ১৯ ও নোটবন্দির ঘটনায়। এইগুলো মানুষের আন্দোলনে প্রভাব ফেলেছে। এই রাজ্যে বামপন্থী ফোর্স ছিল। সেটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম বামফ্রন্ট বিরোধী আন্দোলন থাকলেও বামমনোভাবাপন্ন মানুষের অনুভূতি ছিল। BJP-র প্রভাবের জন্য বিশেষ ধরনের পরিবর্তন এসেছে ভাবনা-চিন্তায়। একদিকে অর্থনৈতিক ধাক্কা, মানুষ জীবন-জীবিকার লড়াই নিয়ে ব্যস্ত, গ্রামে মাইগ্রেসন বেড়েছে। ফলে গ্রামে যুব ছেলেদের পাওয়া খুব কষ্টকর হয়ে গিয়েছে। দশম-একাদশ শ্রেণি পাস করলেই পড়াশুনা বন্ধ করে বাইরে চলে যাচ্ছে। আন্দোলন করা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।
অনুরাধা তলোয়ার- তৃণমূল ও বিজেপি একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছে যে মানুষের অধিকারের দাবির ব্যাপারটা পিছিয়ে গিয়েছে। আপনার অভাব আছে রেশন দিচ্ছি, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার (Lakshmir Bhandar) দিচ্ছি। বামেদের সময় UPA সরকার ছিল। তখন বিভিন্ন গণআন্দোলন হয়েছে। তখন প্রচুর আইন এসেছে, আন্দোলনও হয়েছে। BJP আসার পর ধর্ম, জাতপাত নিয়ে তৎপরতা চলছে, অধিকারের ব্যাপারটা কমে গিয়েছে। এদিকে সরকার সব কিছু করে দেবে। গ্রামে গেলে বুঝতে পারবেন দল বলছে যা করব আমরা করব। কারও কিছু করতে হবে না। আন্দোলনের পরিবেশটা এরাজ্যে ভেঙেছে। দুর্নীতি সামনে এসেছে। মানুষের অধিকার সামনে আসছে না।
প্রশ্ন- বিজেপি-তৃণমূলের 'বাইনারি' পলিটিক্সের কথা বলছেন লোকজন। গণ আন্দোলন দানা বাঁধছে না কেন?
অনুরাধা তলোয়ার- বঞ্চনার বিষয়টা কম নেই। মিড ডে মিলের আন্দোলন করে ৫০০ টাকা বেড়েছে। আন্দোলন দাঁনা বাধছে কিন্তু যেভাবে হোক একসঙ্গে হতে পারছে না। রাজনৈতিক নেতাদের করে খাওয়া আগের থেকে বেড়েছে। রাজনীতি ও সাধারণের মধ্যে স্বচ্ছতা আগের থেকে আরও কমেছে। খারাপ হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে প্ল্যাটফর্মের অভাব হচ্ছে। বিজেপি ও তৃণমূল এই প্ল্যাটফর্ম দিচ্ছে না। আর তৃতীয় রাজনৈতিক দল ডেভেলপ করছে না। ওই প্ল্যাটফর্ম দিতে পারে। আমাদের মতো সংগঠন তুলনামূলক ছোট। আমরা আমাদের মতো আন্দোলন করছি। আমাদের ক্ষমতা এতটা বেশি নেই যে মানুষের যে রাগ আছে সেই প্ল্যাটফর্ম দিতে পারি। তবে যেখানে আমরা দাঁড়াচ্ছি সেখানে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছি না। লোকে তৃতীয় শক্তি চাইছে।
প্রশ্ন- কী ধরনের আন্দোলন করছেন?
অনুরাধা তলোয়ার- NREGA। ১০০ দিনের কাজের ব্যাপারটা কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্পর্ক হিসাবে দেখা হচ্ছে। আমাদের ক্ষেত মজুরদের ইউনিয়ন। আমরা প্রথম কাজ শুরু করি এনআরইজিএ নিয়ে। প্রথম থেকেই আন্দোলনে আমরা ছিলাম। ২০০৬ সাল থেকে যখন আইন আসে তা নিয়ে কাজ করেছি। আমাদের সদস্য বেশিরভাগ ১০০ দিনের কর্মী। ২০২১, ২০২২, ২০২৩-এ নিয়মিত আমরা আন্দোলন করেছি। দিল্লি গিয়েছি। হাইকোর্টে মামলা করেছি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংয়ের (Giriraj Singh) সঙ্গে দেখা করেছি। তাঁর কাছে যুক্তিসহ দাবি জানিয়েছি। ওই আন্দোলনের ফল হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) রাজ্যের তরফ থেকে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছে। কেন্দ্র-রাজ্য বা তৃণমূল-বিজেপি নয়, অন্যরাও আছে। এরাজ্যে ১০০ দিনের বঞ্চনার কাহিনী সারা ভারতে প্রচারে আছে।
প্রশ্ন- কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কী বক্তব্য?
অনুরাধা তলোয়ার- আমরা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংয়ের সঙ্গে ২-৩ বার দেখা করেছি। প্রত্যেকবার মন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, বাংলায় ১০০ দিনের কাজ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। তাই টাকা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু সবাইতো দুর্নীতি করেনি। কিছু লোক তো কাজও করেছে। লোকেরা কাজ করেছে টাকা কেন পাবে না। তার কোনও উত্তর তিনি দিতে পারেননি। দুর্নীতি রোধ করার জন্য ব্যুরোক্রেসি থাকলেও ম্যাকানিজম নেই। সোশ্যাল অডিট, সিস্টেম ব্যবহার না করলে তো দুর্নীতি হবেই। রাজ্যে সাড়ে ৩ কোটি কর্মীর কিভাবে ভ্যারিফিকেশন সম্ভব?
প্রশ্ন- সিঙ্গুর আন্দোলনে ছিলেন। সেখানে শিল্প হয়নি, চাষও হয়নি। অথচ এখন কিছু জমিতে ভেড়ি হয়েছে। কী বলবেন?
অনুরাধা তলোয়ার- সিঙ্গুরকে শুধু সিঙ্গুর (Singur) হিসেবে দেখলে বলতে হবে বিফলতা আছে। কিন্তু ২০০৬-০৭, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তখন জমি শুধু সিঙ্গুরে নিচ্ছিল না হরিপুর, আমডাঙা সহ নানা জায়গায় জমি নিচ্ছিল। লক্ষ্য ছিল, চাষের জমি অকৃষি কাজে ব্যবহার করা হবে। উদ্যোগপতি বা বড়লোকদের দেওয়া হবে। শুধু এই রাজ্যে নয়, সারা ভারতজুড়ে হচ্ছিল। যে ব্রিটিশ পুনর্বাসন আইন ছিল তাতে প্রতিবাদের কোনও জায়গা ছিল না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ তে নতুন পুনর্বাসন আইন এসেছে। সেদিক থেকে আন্দোলন সফল। ওই যে বাধাহীন ভাবে নির্দ্বিধায় জমি নেওয়া সেটা বন্ধ হয়েছে। তাছাড়া জমির সমস্যা থেকে গিয়েছে। দেউচা পাঁচামি আছে, চা বাগানে জমির অধিকার নিয়ে বিরাট আন্দোলন হচ্ছে। লোকেদের জীবন-জীবীকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
দীর্ঘ বছর ধরে বসবাস করলেও জমির ওপর তাঁদের অধিকার নেই। সেখানে ১৯৫৩-তে রাজ্য সরকার জমি নিয়ে নিয়েছে। ৫ ডেসিমেলের পাট্টা দেওয়ার পলিসি নিয়েছে রাজ্য সরকার। তা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে। অথচ মালিকপক্ষ ১৫০ একর জমি কিনে নিতে পারে। মানুষের কাছে জমি এখনও বড় ইস্যু। এটা সীমিত। এখনও জমি অধিকারের আন্দোলন চলছে। সিঙ্গুর ঠেকাতে পেরে নজির তৈরি করেছে। ওখানকার লোকেদের কষ্ট হয়েছে। সিঙ্গুরের লোকেদের কষ্টের জন্য অন্যদের লাভ হয়েছে। জমি কেড়ে নেওয়াটা আটকাতে পেরেছি।
প্রশ্ন- সন্দেশখালিতেও তো জমিই ইস্যু...
অনুরাধা তলোয়ার- সেখানেও ইস্যু জমি। নোনাজল দিয়ে জমি নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। ১৯৮২-৮৩ বাম আমলেই শুনেছিলাম নোনা জল ঢুকিয়ে দিয়ে জমি নিয়ে নিচ্ছে। সাধারণ চাষিরা লড়াই করছে। কিন্তু এমনই অবস্থা বিশ্ব ব্যাংক, সরকার সবাই এনকারেজ করেছে ভেরির চাষ নিয়ে। এটা পরিবেশের জন্য ভীষন খারাপ। এখন দেখছি মানুষের জীবনযাপনের জন্যও খুব খারাপ। আমরা হিসাব করে দেখেছি যে জমিতে জল ঢোকানো হয়েছে, সেখানে আগে ১০০ জন কাজ করত, সেখানে পরে ৭ জন লাগছে। বহু মানুষ কর্মহীন হচ্ছে। তাছাড়া অস্ত্র ঢুকবে, লুঠ হবে, মাফিয়া রাজ কায়েম হবে। এখন যে ধরনের অভিযোগ শুনছি সেই সংস্কৃতি। নোনা জলের ফলে বাড়িতে পুঁই শাক পর্যন্ত লাগাতে পারছে না। পানীয় জল, স্নানের জল নিয়ে সমস্যা বাড়ছে। এর ফলে সেখানে মাইগ্রেশন শুরু হয়েছিল। ওরা বর্ধমানে বছরে তিন-চার বার যাচ্ছিল কাজের জন্য। এই নোনাজল জমিতে ঢোকানোর সমস্যা শুধু সন্দেশখালি নয়, আশপাশের নানা এলাকায় চলছে দীর্ঘ বছর ধরে।
প্রশ্ন- দেউচা-পাঁচামি নিয়ে কী বলবেন?
অনুরাধা তলোয়ার- আমাদের ইউনিয়নের অবস্থান ওখানকার মানুষের সমর্থন দেওয়া। তাদের সঙ্গে কথা বলা। মাইনিংয়ের ক্ষেত্রে নীচে খনন করে নিয়ে নেয়, কিন্তু ওখানকার কোনও উন্নয়ন হয় না। বরং পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। একশ্রেণি লাভ করে স্থানীয় লোকেদের কোনও লাভ হয় না। কয়লা খনন (Coal Mining) কেন করতে হবে বুঝতে পারছি না। এমনিতে কয়লা ব্যবহার নিয়েই প্রশ্ন আছে। কয়লার ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে। ওখানকার লোকেদের সঙ্গে কথা না বলে করা উচিত নয়। পাশাপাশি ওখানকার লোকেদের কি লাভ হবে তা দেখতে হবে। তাছাড়া কয়লা খনি খুব ভালো ব্যাপার তো নয়। রিনিউয়েবল অ্যানার্জির কথা বলা হচ্ছে। কয়লা খনন করে কি হবে? উত্তরবঙ্গে চা বাগানেও একই অবস্থা। চা বাগানের এক কোণে জমি দেব। ওরা জমি থেকে যা রোজগার হয় তাতে বেঁচে আছে। তা নিতে চাইলে আন্দোলন তো হবেই।
আরও পড়ুন- Dilip Ghosh: বেআইনি নির্মাণ নিয়ে তৃণমূলকে তুলোধনা, মারাত্মক অভিযোগ দিলীপের
প্রশ্ন- দিদির (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ) সঙ্গে কোনও কথা হয়? জমিজট নিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠকের কথা কখনও ভেবেছেন?
অনুরাধা তলোয়ার- না। আমরা যখন আন্দোলন একসঙ্গে করেছি যদিও আমি জমি বাঁচাও কমিটির মধ্যে ছিলাম না। তবে আমাদের সংগঠনের লোক ছিল। আমি মমতাদিকে চিনি, আগে যখন দেখা হয়েছে কথা বলেছি। খুব একটা নয়। কিন্তু কাজের ব্যাপারে এখন কোনও কথা হয় না। ওনার সঙ্গে দেখা করা খুব কঠিন। বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। চেষ্টাও করিনি। আমরা মনে করি না এটা কারও একার বিষয়। তবে পশ্চিমবঙ্গে কিছু করতে হলে ওনার সঙ্গে কথা বলা যেতেই পারে। সরকারে আছেন। তবে তাঁর সঙ্গে দেখা করা কঠিন।
প্রশ্ন- পরিবর্তন কতটা হয়েছে? এখন রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণের নীতি থেকে সরেছে।
অনুরাধা তলোয়ার- একটা জিনিস থেকে সরে এসেছে। তবে পার্টিতন্ত্রের পরিবর্তন হয়নি। বামেরা চলে যাওয়ার পর কমেনি, বরং দুর্নীতি হাজারগুণ বেড়েছে। পার্টিতন্ত্রও কমেনি। পুলিশ নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে বা কে কি পাবে, বামফ্রন্টের থেকেও বেশি হয়েছে। সেই খাঁচার মধ্যেই ঢুকে গিয়েছে এরা।
প্রশ্ন- তৃণমূল বা বিজেপির বাইনারি পলিটিক্স হচ্ছে। কী বলবেন?
অনুরাধা তলোয়ার- আমার মনে হচ্ছে জীবনটা বাইনারি না। এই রাজনীতি যতদিন চলবে মানুষের জীবন বাইনারি ততদিন চলবে। কিছু কমন ইন্টারেস্ট আছে। অভাব-অভিযোগ, বঞ্চনা কোনও জাতপাত দেখে না। সাম্প্রদায়িক ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রে টিকছে না। সন্দেশখালিতে প্রচার করলেও টিকছে না। আমাদের সংগঠন সন্দেশখালিতে তদন্ত করতে গিয়েছিল। আমরা বুঝেছি, প্রথমত হিন্দু-মুসলিম নয়, পার্টির ভয়ঙ্কর চাপ আর প্রশাসনকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সন্দেশখালিতে জমিই মূল ইস্যু। জমি কেড়ে নিয়ে টাকা না দেওয়ার ব্যাপার আছে। এই ইস্যুতে মানুষ বিরক্ত। সন্দেশখালি লোকেদের আন্দোলন পার্টির আন্দোলন নয়।