Lok Sabha Election 2024: স্কুলের ব্ল্যাক বোর্ডে প্রায় দেড় ইঞ্চি ব্যাসের গর্ত। কেন ব্ল্যাক বোর্ডে এই অতি সামান্য গর্ত? তা শুনলে এখনও আঁতকে উঠতে হবে। এই ক্ষুদ্র গর্ত বয়ে বেড়াচ্ছে তিন বছর আগের মর্মান্তিক স্মৃতি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর (Central Force) গুলি চালনার ঘটনায় চারজন ভোটারের মৃত্যু হয়েছিল এই স্কুলের বুথের ভোটের লাইনেই। নিকটজনের মৃত্যু যন্ত্রণা এখনও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে পরিবারের সদস্যদের।
মাথাভাঙা (Mathabhanga) ব্লকের আমতলি এমএসকের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা ফ্যাল ফ্যাল করে ক্লাসরুমের ব্ল্যাক বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। ওই ব্ল্যাক বোর্ডের ডান দিকে নীচে মাত্র দেড় ইঞ্চি ব্যাসের একটি গর্ত মনে করিয়ে দিচ্ছে ৩ বছরের আগের হৃদয় বিদারক ঘটনার। ২০২১ বিধানসভার চতুর্থ দফার নির্বাচনে ১০ এপ্রিল শীতলকুচির (Sitalkuchi) এই স্কুলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষণে প্রাণ দিতে হয়েছে আশেপাশে গ্রামের ৪ জনের।
আমতলির (Amtali) স্কুলে ওই গুলি চালনার ঘটনা বিধানসভা নির্বাচনে ছন্দপতন ঘটিয়ে দেয়। স্কুলে গিয়ে দেখা গেল এখন ওই ঘটনার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে তৃতীয় শ্রেণিকক্ষের ব্ল্যাকবোর্ড। স্কুলের শিক্ষক সফিকুল ইসলাম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বলেন, 'গুলি চালনার ঘটনার পর থেকে মাস ছ'য়েকের ওপর ওই ঘর বন্ধ রেখেছিল পুলিশ। তদন্তের স্বার্থে ওই গর্ত বন্ধ করা হয়নি। আমরা তারপর আবেদন করায় ঘরটির দরজার তালা খুলে দেয় পুলিশ। এখানে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস হয়।"
সেদিনের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে আমতলি এমএসকের সম্প্রসারণ কর্মী সফিকুল ইসলাম বলেন, "স্কুলের বাচ্চারা এখনও শিউরে ওঠে। ওই ঘটনার এফেক্ট ওদের মধ্যে হয়। ওদের মধ্যে ভয়-ভীতিও কাজ করে। সেদিন আমিও ভোটের ডিউটিতে পুণ্ডিবাড়ি বুথে ছিলাম। টিফিন আওয়ারে যখন হোটেলে খাচ্ছিলাম তখন টিভির স্ক্রিনে স্কুলের ঘটনাটি দেখতে পাই। তখন আমি আর কাউকে বলিনি ওই গুলি চালনার ঘটনা আমাদের স্কুলে হয়েছে। দু'একজন লোক আমাকে ফোনও করল। আমি আঁতকে উঠলাম যে আমার স্কুলের বুথে গুলি চালনার ঘটনায় ৪ জন সাধারণ ভোটার নিহত হয়। যা শুনেছি এরা কেউ কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা ভাবেতই পারিনি। একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়ি। ঠিক পরের দিন স্কুলে চলে আসি। তখন চারিদিকে আতঙ্কের পরিবেশ।"
আরও পড়ুন- Premium: আশ্বাসে আর মন গলে না! হাজারো উপেক্ষা সয়ে এযেন ‘মুক্তিযুদ্ধ’ জারি বাংলার এই প্রান্তে!
২০২১-এর ১০ এপ্রিল রাজ্যে চতুর্থ দফার বিধানসভার নির্বাচন ছিল। ভোট দিতে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন জোড়পাটকী গ্রামের তিন জন, পাশের গ্রামের ছিলেন একজন। মূল ঝামেলা চলছিল বুথের কিছুটা দূরে। কিন্তু হঠাৎই কেন্দ্রীয় বাহিনী বুথ লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে। জোড়পাটকীর মণিরুজ্জামান, হামিদুল মিঞাঁ, ছামিয়ুল হক ও বোচাগারি গ্রামের নূর আলম মিঞা। ছামিয়ুলের কাকা আজগড় আলি মিঞা বলেন, "তখন মাথাভাঙা কলেজে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছিল ভাইপো। কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে অকালে ঝরে গেল একটি তরতাজা প্রাণ। কারা ঝামেলা করে আর নিরীহ মানুষের প্রাণ চলে যায়।"
একই গ্রামে পাশের বাড়িটি হামিদুল মিঞার। হামিদুল রাজমিস্ত্রির কাজ করত। এই মর্মান্তিক ঘটনার ১৭ দিন পর তাঁর ছেলে হয়। ছোট্ট ফুলের মতো শিশুটি জন্মের পর থেকে বাবাকে খুঁজে বেরায়। আরেক মেয়ের বয়স ৬। হামিদুলের স্ত্রীকে হোমগার্ডের চাকরি দিয়েছে রাজ্য সরকার। হামিদুলের জামাইবাবু আজ্জাদ মিঞা বলেন, "ঘটনার সময় পাশের গ্রামে আমি বোরো চাষের কাজ করছিলাম। গন্ডগোলের খবর পেয়ে ছুটে গ্রামে চলে আসি। তারপর স্কুলে গিয়ে দেখি সব শেষ। চারজনের গুলিবিদ্ধ দেহ স্কুলের মাঠে পরে আছে। তার আগে শুনেছিলাম অন্যদিকে একটা ঝামেলা হয়েছিল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। এরা কিন্তু কেউ তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস বা সিপিএম কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁদের একটাই অপরাধ ছিল লাইনে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে যাওয়া। বুথে কোনও ঝামেলা হয়নি। বাইরে ঝামেলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলি তাঁদের বুক ঝাঁঝরা করে দেয়।"
বাড়ির কাছে চারজনকে পাশাপাশি কবরস্থ করা আছে। শুধু ওই পরিবারগুলি নয়, গ্রামের মানুষের কাছে ৩ বছরের আগের ঘটনা এখনও দগদগে ঘা হয়ে আছে। সেই আতঙ্ক এখনও তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে তাঁদের। আমতলি এমএসকেতে এখনও বাউন্ডারি দেওয়াল হয়নি। স্কুলের মাঠে ঢুকে ডানদিকে শহিদ বেদি তৈরি করা হয়েছে। সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মৃত চারজনের নাম উল্লেখ রয়েছে। এবারও ওই বুথেই ভোট পড়েছে জোড়পাটকী গ্রামের ভোটারদের। আজ্জাদ মিঞার স্পষ্ট বক্তব্য, "সরকার দায়িত্ব নিলে ভোট দিতে যাব। নাহলে ভোট দিতে যাব না। সরকারের লোকজনকেও সেকথা বলেছি। ওরা কথা দিয়েছে শান্তিতে ভোট করাবে।"