Lok Sabha Election 2024: গত বিধানসভার মতো এবারও CPM-এর এক ঝাঁক নয়া প্রজন্ম লোকসভা নির্বাচনে (Lok Sabha Elections 2024) লড়াইয়ের ময়দানে। সৃজন, প্রতিকূর, সায়ন, দীপ্সিতারা নির্বাচনী ময়দানে দিনরাত এক করে প্রচার করছেন। তাঁদের কারও বিরুদ্ধে বাঘা-বাঘা প্রতিপক্ষ। শ্রীরামপুরে দীপ্সিতা ধরের (Dipsita Dhar) বিপক্ষে আছে তিনবারের জয়ী তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Kalyan Banerjee)। তবে লড়াকু দীপ্সিতা ময়দানে থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। নয়া প্রজন্মের এই বাম নেত্রীর লড়াইয়ের ভিত্তি, নির্বাচনী ইস্যু, প্রতিপক্ষের প্রতি ভাবনা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া, নানা বিষয় নিয়ে দীপ্সিতা খোলামেলা আলোচনা করলেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধির কাছে।
প্রশ্ন: এক সময় কিশোর বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা কতটা কাজে লাগছে?
দীপ্সিতা: আমি যেটুকু বলতে পারি, যেটুকু লোকের সঙ্গে মিশতে পারি তার সমস্ত কিছুর হাতেখড়ি প্রাথমিক ভাবে কিশোর বাহিনী (Kishore Bahini) থেকেই। আমাদের শিবির হ'ত, বছরে একটা হ'ত রাজ্য শিবির, আরেকটা জেলা শিবির। চার-পাঁচ দিনের ক্যাম্প করে এমন বন্ডিং হ'ত যে ঘরে ফেরার সময় হাউ হাউ করে কাঁদতাম। একসঙ্গে থাকা, একসঙ্গে খাওয়া, নিজের জামাকাপড় নিজে কাচা, বাসন মাজা। আমার নাচের হাতেখড়িও কিশোরবাহিনী থেকে। কিশোরবাহিনীতে কম খরচে নাচ শেখা যেত। সাংস্কৃতিক পুঁজিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিত কিশোর বাহিনী।
প্রশ্ন: ১৯৯৬-তে কংগ্রেস প্রার্থী প্রদীপ ভট্টাচার্য, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত একবার মাত্র বাম প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। ৭ বারে একবার জয়। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের ভোট শতাংশ ছিল মাত্র ১০.৮। এবার কতটা আশাবাদী?
দীপ্সিতা: পঞ্চায়েত নির্বাচনে শ্রীরামপুরের সমস্ত এলাকায় বাম গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি মিলে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে কতটা কারচুপি হয়েছে সবাই জানে। মা জেলা পরিষদের প্রার্থী ছিলেন। আমি নিজে কাউন্টিং এজেন্ট ছিলাম। আমি দেখেছি যা হয়েছে তা প্রহসনের চাইতে কিছু কম নয়। আমাদের গোনা ব্যালট পেপার যেগুলি জিতেছি সেগুলি বাইরে ফেলে দেওয়া, আমাদের কমরেডদের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া। দিনের পর দিন তাঁরা ঘরছাড়া ছিলেন। এদিকে ইলেক্টরাল বন্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি। তাঁর জন্য ওষুধের দাম বেড়েছে, এখানে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে। তাছাড়া শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, কর্মহারা হওয়া, সন্দেশখালির ঘটনা। এগুলির প্রভাব আছে। এবার পোলারাইজড ভোট হবে না।
প্রশ্ন: 'ভোটপ্রহসন' কী করে আটকাবেন?
দীপ্সিতা: ব্যালট পেপার খেয়ে নেওয়া সহজ। কিন্তু EVM-এর ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। গণনায় কারচুপি পঞ্চায়েত নির্বাচনে হতে পারে এই ধারনা আমাদের ছিল না। আমরা তা থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আমরা প্রস্তুত থাকব প্রতিরোধ করার। এত সহজ হবে বলে মনে হয় না। মানুষের যা ক্ষোভ, মানুষের যা রাগ, পঞ্চায়েত নির্বাচনে যা দেখেছে, আমার মনে হয় তা এই বারের ভোটে প্রতিফলিত হবে।
প্রশ্ন: প্রচারে গিয়ে কি দেখছেন? মানুষ কী বলছে?
দীপ্সিতা: প্রচারে গিয়ে আমরা বলছি এলাকার অসুবিধা কি। এই এলাকার সমস্যা নিয়ে তৃণমূল-বিজেপি কিচ্ছু করেনি। এখানকার বন্ধ কারখানার শ্রমিক মাসে ১ হাজার টাকা করে পেনশন পায়। পুরনো শ্রমিকরা ৮০০ টাকা পায়। একটা সভ্য দেশে ১ হাজার টাকা দিয়ে কি হয়? আমরা ৭ হাজার টাকার দাবি জানাচ্ছি। এমন একটা জ্বলন্ত ইস্যু নিয়ে কেউ কিছু করেননি। এখানকার সাংসদ বা বিজেপি কিচ্ছু করেনি। করেনি রাজ্য বা কেন্দ্র। আমরা বলছি আমাদের জয়ী করুন, আমি নিজে শ্রমিক পরিবারের মেয়ে। আমি জানি কারখানার শ্রমিকরা জোটবদ্ধ হলে কী কী অধিকার পেতে পারে। তাঁরা যদি আমায় সুযোগ দেন পার্লামেন্টে তুলব।
আরও পড়ুন- Premium: কৃষ্ণনগর: মহুয়ার লেখাপড়া-আয় কত? BJP-র অমৃতা রায়ের সম্পত্তির পরিমাণ জানলে ভিরমি খাবেন!
প্রশ্ন: লক্ষ্মীর ভান্ডার নিয়ে তৃণমূলের ছোটবড় সব নেতা প্রচার করছে।
দীপ্সিতা: লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নেওয়ার কোনও অসুবিধা নেই। জনকল্যাণকারী রাষ্ট্র তো ভাতা দেবেই। কিন্তু ভাতার লজিক কী? যে মানুষ কাজ করতে অক্ষম, যিনি কাজ করতে পারছেন না, তাঁদের ভাতা দিক। মানুষের কাজের পরিবেশ দিতে হবে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নিয়ে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিচ্ছে দিক কিন্তু কার্তিক, গণেশ, সরস্বতীরা বেকার যেন বাড়িতে বসে না থাকে। তাঁদের দায়িত্বও তো সরকারকে নিতে হবে।
প্রশ্ন: JNU-এর অভিজ্ঞতা কতটা কাজে লাগছে?
দীপ্সিতা: JNU নিয়ে অনেকেই জানতে চাইছে। বিজেপি বিরোধী মানুষের কাছে JNU মডেলের মতো। তারপর ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত।
প্রশ্ন: বাম-কংগ্রেস কেমন ফল করবে?
দীপ্সিতা: নির্বিঘ্নে যদি ভোট করাতে পারি। নিজের ভোট নিজে দিলে ব্যাপক ভাল ফল এবার পশ্চিমবঙ্গে হবে।
প্রশ্ন: নির্বিঘ্নে বলছেন, এখনও আশঙ্কা তাড়া করে বেড়াচ্ছে….
দীপ্সিতা: আমরা প্রথম পর্বের ভোট দেখেছি। এখনও হুমকি দিচ্ছে। আমাদের বৈঠকী মিটিংয়ে হামলা চালাতে চেষ্টা করছে। একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে। কারণ, পায়ের তলার মাটিটা আলগা হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: সুজন, সেলিম ও সৃজন, এর বাইরেও কিছু আসন আলোচনায় আছে।
দীপ্সিতা: এছাড়াও অন্য অনেক আসনেও লড়াই জোরদার হবে। কৃষ্ণনগর, তমলুক, ডায়মন্ড হারবার, ঝাড়গ্রাম, দক্ষিণ কলকাতা অনেক আছে।
প্রশ্ন: আপনার পাশের কেন্দ্রে লড়াই করছেন রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় ও লকেট চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া দেব, হিরন আছে ঘাটালে।
দীপ্সিতা: এটা একেবারে বিরাজনীতির প্রতিফলন। রাজনীতিতে রাজনীতি যখন কমে যায় তখন সেলিব্রেটি দিয়ে জায়গা ভরাট করতে হয়। তৃণমূল ক্ষমতাশালী হলে তাঁদের নেতা-নেত্রীদের প্রার্থী করতে পারত। আন্দোলন করে উঠে আসাদের প্রতিনিধি না করে এটা করা একেবারে বিরাজনীতি।
প্রশ্ন: রচনা বলছেন রোদে খাটুনি আর দু'মাস!
দীপ্সিতা: রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খারাপ লাগে না। নাইস উওমেন। রচনা অনেস্ট। ওনার মধ্যে কোনও ফিল্টার নেই। উনি তো বলছেন ২ মাস কাজ করতে হবে তারপর আর করতে হবে না। অন্যরা বলেন না। উনি বলেছেন, ভালো মনের মানুষ। আমার ওনার ওপর কোনও রাগ নেই।
প্রশ্ন: অন্যদের ক্ষেত্রেও কি একই কথা প্রযোজ্য?
দীপ্সিতা: একদম। দেখুন না অন্য সেলিব্রেটি সাংসদরা সংসদে কতগুলো বিতর্কসভায় অংশ নিয়েছেন। কতবার পশ্চিমবঙ্গের জন্য আওয়াজ তুলেছেন। তাহলে আপনি পার্লামেন্টে যাচ্ছেন কেন? তাহলে সাংসদ নির্বাচিত হচ্ছেন কেন? যদি পার্লামেন্টে পারফর্ম না করেন।
প্রশ্ন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, কংগ্রেস ও সিপিএম ভোট কাটুয়া পার্টি। ভোট কেটে বিজেপিকে সুবিধা করে দিচ্ছে।
দীপ্সিতা: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাকেশ শর্মাকে চাঁদে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব কথা সিরিয়াসলি ধরলে মুশকিল আছে। ভোট নষ্ট কখন হয়? যখন কেউ মানুষের ভোটে তৃণমূলে জিতে বিজেপিতে চলে যায়। অথবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৈনিক হিসাবে ভোট দেওয়ার পর চাকরি বিক্রি করে টাকাগুলি বান্ধবীর খাটের তলায় রেখে দেয়। সেখানে ভোট নষ্ট হয়। যে মানুষ ভালোমন্দের সময় মানুষের পাশে থাকেন। সেখানে কোনও ভোট নষ্ট হয় না।
প্রশ্ন: রেড ভল্যান্টিয়ার হিসাবে কাজ করেছেন। এই নির্বাচনে তাঁদের কতটা পাশে পাচ্ছেন।
দীপ্সিতা: এই নির্বাচনে তাঁরা প্রত্যেকে পাশে আছেন। তাঁরা মিছিলে আছেন, প্রচারে আছেন। রেড ভলেন্টিয়ার কোনও শখের কাজ ছিল না। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার কোভিডের সময় নিজেদের দায়িত্ব পালন করছিল না সেই গ্যাপটা আমাদের পূরণ করতে হয়েছে। প্রাথমিক দায়িত্ব নাগরিক হিসাবে সরকারকে বাধ্য করা।
প্রশ্ন: এই আসনে সিপিএম গতবার তৃতীয় স্থান পেয়েছে। এবার বিজেপির হাল কি হবে।
দীপ্সিতা: যদি ২০১৪ থেকে দেখি তাহলে দেখা যাবে ২০১৯ এ বিজেপির ভোট চূড়ায় পৌঁছেছিল। কিন্তু আমি মনে করি না বিজেপির সব ভোট সাম্প্রদায়িক ভোট। এর মধ্যে অনেক অসাম্প্রদায়িক ভোট ছিল যাঁরা তৃণমূলকে ভোট না দিয়ে বিজেপিকে দিয়েছিল। তাঁরা ভেবেছিল যে ভাবে হোক তৃণমূলকে হারাতে হবে। তখন কোনও অপশন ছিল না তাই বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন এতো আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার। বিজেপির তৃণমূল বিরোধিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিজেপিতে যাওয়া অসাম্প্রদায়িক মানুষগুলোর ভোট এবার আবার সিপিএমে ফিরবে।
প্রশ্ন: বামেদের ভোট দিতে আহ্বান জানাচ্ছে শুভেন্দু। আবার মমতা বলছেন বামের ভোট রামে যাচ্ছে। কি বলবেন?
দীপ্সিতা: বামেরা কতটা চালাক! নিজেদের ভোট নিজেদের দিচ্ছে না। ৩০-৪০ শতাংশ ভোট অন্যদের দিয়ে দিচ্ছে। সেটা নিজেদের দিচ্ছে না। এটা একেবারে মিথ্যা কথা। সুপরিকল্পিত প্রচার। এবারও নিশীথ প্রামাণিক বলেছেন সিপিএম আমাদের ভোট দিক ওদের পার্টি অফিস খুলে দেব। সেই বিজেপি সেখান থেকে কয়েকশোও কিলোমিটার দূরে ত্রিপুরাতে আমাদের কত পার্টি অফিস ভেঙেছে। কত মানুষকে মেরেছে। আমি নিজে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে দেখেছি। বিজেপির বামপন্থী প্রীতি! তৃণমূলের হাতে যে মানুষ অত্যাচারিত-নিপীড়িত তাঁরা বাঁচতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। যাঁরা ট্র্যাডিশনালি আমাদের ভোটার ছিলেন। তাঁরা দেখলেন তৃণমূলের থেকে এরা আরও ভয়ঙ্কর। তাঁদের ভুল ভেঙেছে। তবে এবার বামের ভোট বামে ফিরবে শুধু তাই নয়, রামের ভোট বিজেপিতে যাঁরা চলে গিয়েছিলেন তাঁদের ভোটও বামে চলে আসবে।
প্রশ্ন: শ্রীরামপুরের সাংসদ কি বোল্ড হবেন?
দীপ্সিতা: একদম। বোল্ড, বাউন্ডারি, আমি ক্রিকেট খুব একটা ভালো খেলি না। দেখি যদিও। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় অঙ্গভঙ্গী করেন, নাচগান করেন, কখনও ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদেন। যা করেন না শ্রীরামপুরবাসীর অসুবিধা নিয়ে সংসদে কিছু বলেন না। আমি চাইব এমন মানুষ নির্বাচনে জিতুক যে নাটক, ডায়লগবাজি ছাড়া সাধারণ মানুষের কাজ করার জন্য জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাবে।
প্রশ্ন: সংসদে গিয়ে কি বলবেন?
দীপ্সিতা: আমি বলেছি বন্ধ কারখানা খোলা আমাদের প্রায়োরিটি। তাছাড়া এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা, রেলের গেট পড়া, আন্ডার পাশের সমস্যা- মাস্টার প্লান দরকার, ফুরফুরা থেকে ডানকুনি রেল লাইন, ডানকুনি লোকাল, তাঁর সংখ্যা বাড়ানো। মেট্রোর এক্সটেনশন যাতে হয় সেই চেষ্টা করব। বন্ধ বাস রুট চালানো পাশাপাশি এসি বাসের সংখ্যা ও রুট বৃদ্ধি। তাঁত, জড়ি শিল্প বাঁচানোর উদ্যোগ। সাংসদ কোটার এক তৃতীয়াংশ টাকায় মহিলাদের আত্মরক্ষা বা আত্মমর্যাদার ট্রেনিং সেন্টার খোলা।