তৃতীয়বার বিপুলভাবে ক্ষমতায় এসেও স্বস্তিতে নেই তৃণমূল কংগ্রেস। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের পর একবছর কার্যত বিজেপি রাজনীতির ময়দানে দাগ কাটতে পারেনি। বরং তাঁদের তৎকালীন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাশ বিজয়বর্গীয়কে এরাজ্যে দেখাই যায়নি। তা সত্বেও কিন্তু ক্ষমতায় আসার দেড়বছরের মধ্য়ে রাজনীতিতে নিজের 'বীতশ্রদ্ধ'-এর কথা বলছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়। চিটফান্ড কেলেঙ্কারি বা নারদাতে অনেক বেশি তৃণমূল নেতা-মন্ত্রী গ্রেফতার হয়েছেন, তবু তিনি সামলে নিয়েছেন। এবার কিন্তু ভিন্ন সুর তৃণমূল নেত্রীর গলায়।
বুধবার সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, 'সমাজসেবা করার জন্যই রাজনীতিতে এসেছি। তা নাহলে এই ধরনের 'ডার্টি পলিটিকস' দেখলে অনেক দিন আগেই রাজনীতি থেকে বিদায় নিতাম। আমি এই রাজনীতি পছন্দ করি না। কুৎসা, অসত্য় অকথ্য় ভাষায় কথা বলা মানুষকে 'মিনিমাম রেসপেক্ট' না দেওয়া আরেক ধরনের ব্লাক মেইলিং পলিটিকস শুরু হয়েছে। এত টাকা দাও নাহলে তোমার বিরুদ্ধে পোল খুলবো।' অভিজ্ঞমহলের মতে, অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতিকরা তাঁদের বক্তব্যে নানা ইঙ্গিত দিয়ে দেন। সময়ে তা পরিস্কার হয়।
আরও পড়ুন- সম্পত্তি নিয়ে মুখ্যসচিবকে বেনজির নির্দেশ মমতার, ‘বেনিয়ম থাকলেই বুলডোজ করুন’
বাম জমানায় আন্দোলন করতে গিয়ে নানা জায়গায় আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন তৎকালীন যুব কংগ্রেসনেত্রী। পরবর্তীতে তৃণমূল কংগ্রেস গঠিত হওয়ার পরও দীর্ঘ দিন ধরে লড়াই চালিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কখনও কিন্তু তিনি লড়াই থেকে সরে আসেননি। তবে তৃতীয়বার বাংলার তখতে বসেও যেন অস্বস্তি তাড়া করে বেড়াচ্ছে 'বাংলার মেয়েকে'। কেন তিনি রাজনীতি থেকে বিদায়ের কথা বলছেন? ধন্দে পড়েছে রাজনৈতিকমহলও।
প্রায় দেড় মাস আগে রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ গ্রেফতার হয়েছেন তৃণমূলের তৎকালীন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তার কয়েক দিন পরে গ্রেফতার হন বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মন্ডল। এখনও তাবড় এই দুই নেতৃত্বের জামিন হয়নি। এরইমধ্যে সোমবার মেয়োরোডে দলের ছাত্র সমাবেশে তৃণমূলনেত্রী সংশয় প্রকাশ করেছেন কবে আবার ফিরহাদ হাকিমকে গ্রেফতার করবে। তিনি বলেছেন, 'ববিকে গ্রেফতার করলে জানবেন সব সাজানো। একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না।' তার আগে, ওই মঞ্চেই অভিষেক বলেছেন, 'এই সমাবেশের পরেই হয়তো কাউকে গ্রেফতার করবে। তবে গ্রেফতার করেও তৃণমূলকে দমিয়ে রাখা যাবে না।'
আরও পড়ুন- ‘আমি করি না, আমার কাছে অনেকে সেটিং করতে আসে’, বিস্ফোরক মমতা
কয়েকমাস আগে করোনা আবহে ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ তথা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিগত মতামত বলে বক্তব্য রেখেছিলেন। তা নিয়ে দলের একাংশ প্রকাশ্যে নানা মন্তব্য করেছিলেন। তাঁদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে চিৎকার জুড়েছিলেন। যদিও একসময়ে তা থমকে যায়। পরবর্তীতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রসঙ্গে দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের মন্তব্যের জেরে ফিরহাদ হাকিম ফোঁস করে উঠেছিলেন। কুণাল পাল্টা মন্তব্য করেছিলেন। এখনও দলের বেশিরভাগ সাংবাদিক বৈঠক করেন কুণালই। এক্ষেত্রেও বার্তা স্পষ্ট বলে মনে করছে অভিজ্ঞমহল।
রাজনৈতিক মহলের মতে, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অনুব্রত মন্ডলের গ্রেফতারি, ফিরহাদকে নিয়ে মমতার আশঙ্কা যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী। তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থানে মমতার সঙ্গী ছিলেন পার্থ, অনুব্রতরা। তৃতীয়বারের তৃণমূল জমানায় সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যে এদের চোর বলছেন। বিরোধীরা এরইমধ্যে অভিযোগ করছেন, মমতাপন্থীরা গ্রেফতার হচ্ছেন। বেঁচে যাচ্ছেন অভিষেকপন্থীরা। চোর ধরো জেল ভরো, আন্দোলন করে চলেছে সিপিএম। যা নিয়ে এদিন বর্ধমান শহরে ধন্ধুমার কান্ডও ঘটে যায়।
মমতা বলছেন, 'সারা জীবন জেনেশুনে অন্য়ায় করিনি।' দিনের পর দিন অপমানিত হওয়ার কথা বলছেন তিনি। রাজনৈতিক মহলের মতে, ঘরে-বাইরে চাপ বাড়ছে। উন্নয়নের প্রচারে টানা তিনবার ক্ষমতায় থেকেও রাজ্যের রাজনৈতিক ঘনঘটা সমস্যা আরও বাড়িয়েছে। তারওপর রয়েছে ক্রমাগত বিজেপির সঙ্গে সেটিং তত্বের প্রচার। এবার তা-ও খন্ডন করার চেষ্টা করেছেন মমতা। মোদ্দা কথা রাজনীতির পরিবেশ নিয়ে মমতা যে অসন্তুষ্ট তা এদিন পরিস্কার করেছেন।