২০০০ এর গোড়ার দিকে ব্যবসায়ী সুদীপ্ত সেন সারদা গ্রুপ তৈরি করেন। সারদা গোষ্ঠী ছিল অনেকগুলি কোম্পানিকে নিয়ে তৈরি করা এক কনসোর্টিয়াম, যারা ছোট ছোট বিনিয়োগকারীদের বেশি বেশি রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দিতে শুরু করে। একেবারেই ক্লাসিকাল পঞ্জি (ponzi) স্কিমের ধাঁচে কাজ চলতে থাকে, এজেন্টদের বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা শুরু হয়। এজেন্টদের কমিশন ছিল ২৫ শতাংশের বেশি।
কয়েক বছরের মধ্যেই ২৫০০ কোটি টাকার বেশি বাজার থেকে তুলে ফেলে সারদা। ফিল্মস্টারদের এনডোর্স করে, জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাবে বিনিয়োগ করে, বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের মালিকানার মাধ্যমে, দুর্গাপুজো সহ বেশ কিছু অনুষ্ঠানের স্পনসরশিপের মাধ্যমে নিজেদের ব্র্যান্ড বানিয়ে ফেলে। সারদার ব্যাপ্তি পশ্চিমবঙ্গ অতিক্রম করে পৌঁছে যায় ওড়িশা, আসাম এবং ত্রিপুরাতেও। বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা ১৭ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।
সারদার মুখ থুবড়ে পড়া
২০০৯ সালে সারদার জালিয়াতি নিয়ে অভিযোগ তুলতে শুরু করেন রাজনীতিবিদরা। ২০১২ সালে সারদাকে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা তুলতে নিষেধ করে সেবি। ২০১৩ সালে প্রথমবার, সারদায় নগদ আয়ের থেকে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখনই বিপদঘণ্টি বেজে ওঠে।
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে গোটা স্কিম ভেঙে পড়ে। বিনিয়োগকারী এবং এজেন্টদের পক্ষ থেকে বিধাননগর পুলিশের কাছে শয়ে শয়ে অভিযোগ জমা পড়ে। সুদীপ্ত সেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে যান। তার আগে ১৮ পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে যান তিনি, যে চিঠিতে বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের নামে অভিযোগ করেন তিনি। তাঁর বক্তব্য ছিল, তাঁর হাত মুচড়ে রাজনীতিবিদদের ক্রমাগত টাকা নিয়ে নেওয়ার ফলেই এই স্কিম মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল সোনমার্গে গ্রেফতার হন সুদীপ্ত সেন।সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহযোগী দেবযানী মুখার্জি।
তদন্তে জানা যায় দুবাই, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সিঙ্গাপুরেও বিনিয়োগ করেছিল সারদা গোষ্ঠী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সমস্ত এফআইআর একসঙ্গে তদন্তের জন্য একটি বিশেষ তদন্ত দল তৈরি করে। একই সময়ে আসাম সরকার এ বিষয়ে তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার পর তদন্ত শুরু করে সিবিআই-ও। ইডি আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়ের করে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে।
২০১৪ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট সমস্ত মামলা সিবিআইয়ের হাতে ন্যস্ত করে। এক বছর ধরে বিশেষ তদন্ত দল যা তদন্ত করেছিল, সে সমস্ত কাগজপত্র এবং তথ্য প্রমাণ এবং অভিযুক্তদের সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার কথা তাদের।
তৃণমূল যোগ
ব্র্যান্ড তৈরির জন্য রাজনৈতিক সম্পর্ক পোক্ত করে তুলেছিলেন সুদীপ্ত সেন। বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যমের দখল নিয়েছিলেন তিনি এবং বাংলা চলচ্চিত্র জগতেও বিনিয়োগ করেছিলেন। টিএমসি সাংসদ তথা চলচ্চিত্রাভিনেত্রী শতাব্দী রায় এবং রাজ্যসভার সদস্য মিঠুন চক্রবর্তী ছিলেন সারদার ব্র্যান্ড অ্যম্বাসাডর। ২০১৩ সালের মধ্যে সারদা পাঁচটি ভাষায় ৮টি সংবাদপত্র চালাতে থাকে। ১৫০০ সাংবাদিক কাজ করত তাদের অধীনে। গোটা সংবাদগোষ্ঠীর সিইও ছিলেন টিএমসি সাংসদ কুণাল ঘোষ। তাঁর বেতন ছিল মাসে ১৬ লক্ষ টাকা।
কলকাতা পুলিশকে মোটর সাইকেল উপহার দিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী। রাজ্যের নকশাল অধ্যুষিত এলাকায় অ্যাম্বুল্যান্স এবং মোটর সাইকেল প্রদান করে সরকার, যা স্পনসর করেছিল সারদা গোষ্ঠী।
আরও পড়ুন, বিজেপিতে ভারতী ঘোষ, দলে যোগ দিয়েই মমতার প্রতি আক্রমণাত্মক প্রাক্তন আইপিএস
সারদার সঙ্গে কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী মাতঙ্গ সিং এবং তৎকালীন কংগ্রেস ও বর্তমান বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মারও যোগাযোগ ছিল বলে অভিযোগ।
সিবিআই বেশ কিছু তৃণমূল বিধায়ক ও সাংসদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। গ্রেফতার করে সৃঞ্জয় বসু, মদন মিত্র ও কুণাল ঘোষকে। জেরা করা হয় টিএমসি সহ সভাপতি তথা রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার, তৃণমূল যুব কংগ্রেসের প্রধান শঙ্কুদেব পাণ্ডা, সাংসদ শতাব্দী রায় এবং তাপস পালকে।
মমতার নির্ভরযোগ্য সাথী, বর্তমান বিজেপি নেতা মুকুল রায়কেও জেরা করেছিল সিবিআই।
পুলিশ কর্তা এর মধ্যে এলেন কোথা থেকে?
মমতা সরকার যে তদন্ত দল গড়েছিল, তার মাথায় ছিলেন কলকাতা পুলিশের কমিশনার রাজীব কুমার। সিবিআইয়ের দাবি, বেশ কিছু খোয় যাওয়া তথ্য প্রমাণের খোঁজে গত দেড় বছর ধরে রাজীব কুমার সহ সিটের বেশ কয়েকজন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইছে তারা। কিন্তু রাজীব কুমার ও তাঁর সহকর্মীরা সে জেরা এড়িয়ে চলেছেন।
Read the Full Story in English