Bholanath Das & Sons: কলকাতা এমন একটি শহর যার আনাচে-কানাচে রয়েছে ইতিহাস। এই ইতিহাসকে খুঁজে নিতে শুধু বেড়িয়ে পরতে হয়। ধুলো বালি ঝেড়ে বেড়িয়ে আসে মূল্যবান এই সময়। যাকে যুগের পর যুগ আগলে রেখেছে এই শহর। কাল যে ছিল বর্তমান আজ তা অতীত। সময়ের নিয়মে বদলাতে থাকে মানুষ। কলকাতার বয়স বাড়ে। অভিজ্ঞতার ঝুলির ফর্দ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। সময়ের গল্প বলার জন্যে রয়ে যায় কিছু সময় রক্ষকেরা। কলকাতার এমনই এক সময় রক্ষক ভোলানাথ দাস অ্যান্ড সন্স।
শিয়ালদহ ষ্টেশন থেকে এম জি রোড ধরে কলেজ স্ট্রিটের দিকে হাঁটলে বাঁদিকের ফুটপাথের ধারেই একটি ছোট্ট ঘড়ির দোকান। পুরনো এক অট্টালিকার এক কোণে দাঁড়িয়ে পুরনো কলকাতার সময় আঁকড়ে ধরে আছে। দোকানের দেওয়াল জুড়ে ঝুলছে বয়সের জানান দিচ্ছে সময় যন্ত্রেরা।
১০০ বছরেরও বেশি পুরনো এই দোকানটিতে আজও দম দেওয়া ঘড়ি সারাই করা হয়। পিতামহ ভোলানাথ দাসের নামাঙ্কিত এই দোকানের দায়িত্বে তাঁর বছর সত্তরের পৌত্র গোপালচন্দ্র দাস। একসময় এই দোকানটির একই সঙ্গে ছিল গয়না, ঘড়ি সারানোর দোকান এবং একটি ছোটখাটো প্রাইভেট ব্যাঙ্ক। শুনতে অবাক লাগলেও এই ১০০ বছরের দোকানটির ইতিহাস ছিল এমনই আকর্ষণীয়। যদিও তা আজ এই একফালি ভগ্নাংশের মধ্যে কোনওমতে টিকে রয়েছে।
গোপালবাবু ঘড়ি সারাই করতে করতে বলছিলেন সেই ইতিহাস, "আমি যতদিন আছি এই দোকানও ততদিন টিকে আছে। বাপ, ঠাকুরদার দোকান বলে এত সহজে ছেড়ে দিতে পারিনি। আমার পরে এই দোকান চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো আর কেউ নেই।"
গোপালচন্দ্র দাসের কথায়, প্রথমে তিনি ছিলেন পেশায় ফটোগ্রাফার। পরবর্তীতে শরিকি বিবাদের কারণে এই ঐতিহ্যশালী দোকান ভাগ হয়ে যায়। একফালি দোকানেই তিনি বাবার সঙ্গে ঘড়ি সারাইয়ের কাজ শিখতে থাকেন। ধীরে ধীরে এটাই তাঁর পেশা হয়ে ওঠে। গোপাল বাবুর কাছে রয়েছে পুরনো আমলের সব হাত ঘড়ি। যা ছড়িয়ে আছে দোকানের আনাচে কানাচে। ৭০ বছরের ওপরে এই বৃদ্ধের এখনও ধ্যান-জ্ঞান শুধুই এই দোকান। এখানেই সকাল থেকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করে চলেন। খদ্দেররা সব আসেন তাঁদের সব পুরনো সব ঘড়ি নিয়ে। তিনি হাতে নিয়েই বুঝে যান ঘড়ির অসুখ।
আরও পড়ুন- WBJEE 2024 Topper: ধনুকভাঙা পণেই গগনচুম্বী সাফল্য! জয়েন্টে প্রথম কিংশুকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানেন?
কলকাতায় এমন অনেক হেরিটেজ দোকান কিংবা বাড়ি আছে যাদের বয়স ১০০ বছর পার হয়ে গেলেও জোটেনি হেরিটেজ তকমা। তারই মধ্যে অন্যতম ভোলানাথ দাস এন্ড সন্স। দোকানের ফুটপাথের ধার দিয়ে রোজ কত মানুষ হেঁটে যায়। কেউ কেউ হয়তো থমকে দাঁড়িয়ে দেখে নেন। বুঝে যান দোকানের বয়স, একশ বছরেরও বেশি পার করে ফেলেছে। রং ওঠা দেওয়ালের বুকে ঝুলে থাকা ঘড়িগুলোর বড় পেন্ডুলামগুলো হেলতে দুলতে জানান দেয় বৃদ্ধ বয়সের।
ফরাসি, জাপানি, জার্মান, আমেরিকান এবং ভারতীয় সব মিলিয়ে কম বেশি অনেক পুরনো ‘অ্যান্টিক’ ঘড়ি রয়েছে গোপালচন্দ্র দাসের কাছে। যা বহু মূল্যবান। একেকটি ঘড়ির রয়েছে একেক রকমের বৈশিষ্ট্য। একটি ঘড়ি আছে সোনা দিয়ে তৈরি, আরেকটিতে হীরে বসানো। রোলেক্স, ওমেগা, টিসো থেকে শুরু করে অনেক কুলীন গোত্রীয় হাতঘড়ি তাঁর গোপালবাবুর পরিচর্যায়। কোনও ঘড়ির লিভার বদলাতে হবে, কোনটির স্প্রিং, কোনও ঘড়ি পুরো অকেজো তা নিখুঁতভাবে হয় সারাই। এসব কাজই তাঁর নখ দর্পণে। কিছু ব্রিটিশ, ফরাসি আর সুইস দেওয়াল ঘড়ি এখনও সচলভাবে রয়েছে দোকানে। যা অবাক করার মতো।
একটা পুরনো শহর। তার মধ্যেই অসংখ্য প্রাচীন কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এরকমই ছোট ঘড়ির দোকান ভোলা নাথ দাস এন্ড সন্স। এখানেই পুরনো সময়যন্ত্রের রক্ষা করে যাচ্ছে গোপাল চন্দ্র দাসের মতন মানুষরা। দোকানের দেওয়ালের গায়ে ঝুলতে ঘড়িগুলোর পেন্ডুলামগুলোর দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই বলে ওঠেন, “আমার দোকানই আমার সব। ছবি তোলা ছিল একসময় আমার নেশা এখন ডিজিটাল হয়ে গেছে। ঠিক তেমনই ডায়াল ঘড়ির বদলে সবার হাতে স্মার্ট ওয়াচ। আমি যতদিন এই পৃথিবীতে আছি পুরনো জিনিস গুলো নিয়েই বেঁচে থাকব। বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করব পুরনো এসব ঘড়িগুলোকে।"