বাড়িতে এখনও প্লাস্টার হয়নি। সিমেন্ট গাঁথা ইটের খাঁচা বেরিয়ে রয়েছে সর্বত্র। আমতার সারদা দক্ষিণ খানপাড়ায় আনিসদের নির্মীয়মান তিন তলা বাড়ির নীচের তলায় রান্না ঘর, খাওয়ার ব্যবস্থা। দোতলায় বাড়ির দরজার দিকের ঘরে আনিসের বাবা সালেম খান, পাশের ঘরে থাকেন আনিসের দাদা সাবির খান ও বৌদি। মাঝে ডাইনিং। উল্টোদিকে কোনের ঘরে ছিলেন ভাগ্নী। দোতলায় সিড়ির পাশের ঘরটাই আনিসের। তিনতলার ঘর এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। আত্মীয় ইব্রাহিমের দাবি, পুলিশ যখন ঘরে ঢোকে তখন দোতলায় আনিসের ঘরের দরজা খোলা ছিল। আনিসের দরজা খোলা দেখে অন্য ঘরে টোকা না মেরে পুলিশ সোজা ছাদে চলে যায়। সেখানে ফোনে কথা বলছিল আনিস।
অভিযোগ, তারপরই ওপর থেকে নীচে বাড়ির দরজার সামনে পড়ে যায় আনিস। অর্ধনির্মিত চার তলার এক কোনের ঘরে আনিসের জুতো ছিল বলে দাবি করেছেন আনিসের মামা ইব্রাহিম। সেখানে আনিস ফোনে কথা বলছিল বলে সে জানিয়েছে। দিনভর মন্ত্রী, সাংসদ বা মুখ্যমন্ত্রীর দূতের আনাগোনা সত্বেও কোনও মূল্যেই আনিসের পরিবারের লোকজন আপোষ করবেন না বলে এদিন জানিয়ে দিয়েছেন।
আনিসের মৃত্যুর পর শনিবার সন্ধ্যে থেকে কলকাতায় পার্কসার্কাসে বিক্ষোভ হয়েছে। খুনীদের গ্রেফতারের দাবিতে ঝড় উঠেছে রাজ্যজুড়ে। ক্ষোভ-বিক্ষোভের পারদ চরেছে আমতার সারদা দক্ষিণ খানপাড়াতেও। সোমবার আনিসের বাড়িতে সারা দিনই নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ভিড় জমিয়েছেন পুরুষ, মহিলারা। মন্ত্রী-সাংসদদের উপস্থিতিতেই বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন স্বজন ও গ্রামবাসীরা। তাঁদের দাবি, সিবিআই তদন্ত চাই। খুনিদের শাস্তি চাই।
আরও পড়ুন- CBI তদন্তেই অনড় পরিবার, আনিসের বাবা-অন্যান্যদের বয়ান রেকর্ডে ‘না’, ফিরল SIT
হাওড়ার আমতার দক্ষিণ খানপাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, দিনভর বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন আনিসের পরিবার ও প্রতিবেশীরা। রাজ্যের মন্ত্রী পুলক রায় ও সাংসদ সাজদা আহমেদের উপস্থিতিতে প্রতিবাদ আরও জোরালো করেছেন স্থানীয়রা। মুখ্যমন্ত্রীর চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়েছেন আনিসের পরিবার। তাঁদের পরিবারের কাছে চাকরির প্রস্তাব এসেছিল বলে দাবি করেছেন আনিসের কাকা জালিম খান। এদিন আলিয়ার এই প্রাক্তনীর বাড়ি গিয়েছেন আইএসএফের বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকি, বিনায়ক সেন, এপিডিআর-এর প্রতিনিধি। তদন্ত করতে গিয়েছেন উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকও। গ্রামে বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বাড়িতে পুলিশ প্রহরা বসানো হয়েছে।
এদিকে তিন তলা থেকে লাফিয়ে পালাতে গিয়ে ওপর থেকে পড়েছেন আনিস, এই তত্ব কিছুতেই মানতে নারাজ তাঁর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশিরা। তাঁদের দাবি, মাথার পিছনের গভীর ক্ষত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তাঁর পিসতুতো ভাই সামিম খান। কেউ তাঁর মাথার পিছনে ভারি বস্তু দিয়ে আঘাত করেছে বলেই তাঁর দাবি। পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য, 'জলসায় তখনও মাইক বাজছিল। মাইকের জোরাল শব্দ ছিল। সেই সময়টাকেই তাই বেছে নেওয়া হয়েছিল। আধঘন্টা আগে যে আনিস বাড়িতে এসেছে সেই তথ্যও ছিল ওই এক স্টার ওয়ালা পুলিশ ও তিন সিভিকের কাছে।' 'স্যার' কাজ হয়ে গিয়েছে, এতে পুলিশের ওপর আরও সন্দেহ বেড়েছে আনিসের পরিবারের।
আরও পড়ুন- আনিস মৃত্যু তদন্ত: পদক্ষেপ পুলিশের, সাসপেন্ড এক ASI সহ ৩ পুলিশকর্মী
আনিসের আত্মীয় ইব্রাহিম খান বলেন, 'একজনের কাছে ছিল গাদা বন্দুক। বাকি তিন জন ছিল সিভিক পুলিশ। একেবারে পরকল্পিত ভাবে খুন। মেরে ওপর থেকে ফেলে দিয়েছে। পুলিশ পোষাকে এসে এমন ঘটনা ঘটালে পুলিশকে কী করে বিশ্বাস করা যায়। পাশে বাড়ির ভিতরের রাস্তা দিয়ে ওরা পালিয়ে গিয়েছে। সেই রাস্তা দিয়ে আমরাও যেতে পারব না।'
এদিকে আনিসের আত্মীয় ইব্রাহিমের দাবি, 'যদি পালাবো মনে করতে তাহলে তিনতলার ছাদ থেকে পাশের বাড়ির ছাদ অনায়াসে টপকে পিঠটান দিতে পারত আনিস। ও তখন চারতলায় ফোনে কথা বলছিল। সেই সুযোগেই তাঁর ওপর আঘাত করে। তিন তলা থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছে।' আনিসের বাবা সালেম খান এদিনও দাবি করেছেন, 'হাতে বন্দুক নিয়ে পুলিশের পোষাক পরে এসেছিল একজন, বাকি তিনজন ছিল সিভিক। ওরা খুন করে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে আমার ছোট ছেলেকে।' দাদা সাবির খান, পিসতুতো ভাই সকলেরই এক দাবি। পুলিশের হাজিরাকে যে সন্দেহের উর্দ্ধে রাখা হচ্ছে না তা জানিয়েও দিয়েছেন রাজ্যের উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্তা। জানা গিয়েছে, এর আগেও সারদা দক্ষিণ খানপাড়ার বাড়িতে পুলিশ এসেছে আনিসের খোঁজে। বাগনান কলেজে এক পড়ুয়ার ভর্তি হওয়ার সময় টাকা চাওয়ার ঘটনায় প্রতিবাদ করেছিলেন আনিস। সেই সময় তাঁকে ঝামেলায় জড়ানো হয়েছিল বলে পরিবারের দাবি। তাঁদের কথায়, তখনও তাঁকে বেধরক মারধর করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন- আনিস-তৃণমূল যোগ: মুখ্যমন্ত্রীর দাবি অস্বীকার মৃতের বাবার, এবার ড্যামেজ কন্ট্রোলে পার্থ
খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে আনিসের বাড়ির উঠোনেই উঠছে মুহূর্মুহু স্লোগান। একই সঙ্গে দাবি উঠেছে, সিবিআই তদন্তের। রাজ্য পুলিশ প্রশাসনের ওপর কোনও ভরসা নেই বলেই জানিয়েছেন আনিসের দাদা সাবির খান। সে কোনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না বলেও দাবি তাঁদের। তবে পৌর নির্বাচনে উলুবেড়িয়ায় এক আইএসএফ প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় আনিস হাজির ছিল বলে জানা গিয়েছে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন তৃণমূলের সঙ্গে আনিসের ভাল সম্পর্ক ছিল। নির্বাচনে সে হেল্প করেছিল। তবে আনিস কখনও প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেনি বলেই পরিবারের সদস্যদের দাবি।
পরিবারের ছয় ভাইবোনের মধ্যে আঠাশ বছরের আনিস সকলের ছোট। মেজ ভাই সম্প্রতি সৌদিতে গিয়েছেন চাকরির জন্য়। বড় ভাই সাবির খান সিকিমে মিলিটারি ক্যান্টিনে কাজ করেন। তিন বোনের বিয়ে হয়েছে গ্রামেই। বাবা সালেম খান পুত্রশোকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। প্রতিবেশি সুবেদ আলি খাঁ, মোতাহার হোসেন, আশাদুল খাঁয়েদের দাবি, আনিসের মৃত্যু নিছক কোনও আত্মহত্যার ঘটনা নয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাঁর জীবন বিপন্ন হয়েছে। অন্য়ায়ের প্রতিবাদ করাটাই আনিসের কাল হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও পাড়প্রতিবেশিরা।