গ্রামীণ সংসদের ভোট মানেই যেন উদ্বেগ, অশান্তি, খুন, জখম, ঘরছাড়া। তবে রাজ্যের এ এক অন্য পঞ্চায়েত নির্বাচনের কাহিনী। এখানে হিংসা, দ্বেষ, অশান্তিকে পকেটে পুড়েই জোরদার চলছে ভোটের লড়াই। ভোটের দুদিন নিজ নিজ দলের হয়ে ময়দানে থাকলেও ভোট মিটতেই আবার একসঙ্গে আড্ডা, এক ঠোঙায় মুড়ি খাওয়া। এখন একই দেওয়ালে তৃণমূল, বিজেপি ও সিপিএমের প্রচার। এ যেন পাশাপাশি থেকে সুষ্ঠু রাজনৈতিক লড়াইয়ের বড় দৃষ্টান্ত। গ্রামে গ্রামে শান্তি রক্ষা ও সৌভ্রাতৃত্বের লড়াইতে সামিল তৃণমূল, বিজেপি ও সিপিএম।
সূর্য সবে ঢলে পড়েছে। বাঁকুড়ার মুকুটমনিপুরের প্রায় শুকিয়ে যাওয়া জলাধারের দিকেও এখন মানুষের টান নেই। প্রায় শুনশান। এই জলাধারের পাশেই খালের লকগেটের সেতু পার হয়ে একটু উত্তরের রাস্তার ঢালুতে নামতেই দেখা মধ্যবয়স্কা ফুলমনি হাঁসদার সঙ্গে। পড়ন্ত বিকেলে কালভার্টে বসেছিলেন। গ্রামের হালহকিকত জিজ্ঞেস করতেই ফুলমণি হাঁসদা বলেন, 'এখানে কোনও অশান্তি নেই। প্রার্থীরা যে যাঁর মতো প্রচার করছে।'
ভোট নিয়ে গ্রামে কোনও ঝঞ্ঝাট নেই জানিয়ে দিলেন টুডুলাল হাঁসদা, নির্মল মুর্মুরাও। গ্রামে কংক্রিটের রাস্তা, পানীয় জলের সরবরাহ যেমন আছে পাশাপাশি মাটির রাস্তা, আবাস যোজনার বাড়ি না পাওয়া নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে। এতদ সত্বেও গ্রামবাসীদের প্রত্যেকের মুখেই শান্তির বার্তা। নির্বাচন নিয়ে কারও চোখে-মুখে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই। বরং এমন প্রশ্ন শুনেই তাঁরা হতবাক। গ্রামবাসীরা কোচবিহার, ভাঙড়ের হিংসার কথা ভাবতেই পারছে না।
মনোনয়ন পর্ব থেকে রাজ্যে এখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক হিংসায় ১৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ভাঙড় থেকে কোচবিহার রাজনৈতিক সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়েছে। রক্তস্নাত পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে সোচ্চার হয়েছে বিরোধীরা। ভোট রাজনীতিতে অশান্তির, হানাহানির মধ্যে একটু হলেও মন ভালো হওয়ার খবর আদিবাসী অধ্যুষিত জঙ্গলমহলে। বাঁকুড়ায় খাতড়ার গোড়াবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের চিত্রটা কিন্তু অনেকটা ভিন্ন। এখানে এক যোগে শান্তির সুরে গলা মেলাচ্ছেন তৃণমূল, সিপিএম ও বিজেপি নেতৃত্ব। ভোটের লড়াই যে অশান্তির পর্যায়ে যাবে না তা নিয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে গ্রামবাসীরাও।
গোড়াবাড়ি পঞ্চায়েতের রাস্তার একপাশে মুকুটমণিপুর অন্যদিকে পেরিপাথর গ্রাম। গ্রামের রাস্তায় দেখা সিপিএম প্রার্থী দশরথ হেমব্রমের সঙ্গে। তাঁর মুখেও কোনও অশান্তির কথা নেই। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে দশরথ বলেন, 'এখানে কোনও সন্ত্রাসের পরিবেশ নেই। কোনও ঝামেলা -ঝঞ্ঝাট নেই।' কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন আছে? সিপিএম প্রার্থী বলেন, 'কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলে ভালো। তবে এই সব এলাকায় কোনও গন্ডগোল হয় না।'
পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যে বিভিন্ন জায়গায় লাগাতার সন্ত্রাসের অভিযোগ করে চলেছে বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস। ভাঙড়, মিনাখাঁ, বজবজ, এছাড়াও বেশ কয়কটি জেলায় পঞ্চায়েতে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি। এক্ষেত্রে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ এনেছেন বিরোধী দলগুলি। পাশাপাশি তাঁদের কর্মীদের খুন করা হচ্ছে বলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করছে বাম, কংগ্রেস ও গেরুয়া শিবির। কিন্তু অনেকটাই ভিন্ন সুর শোনা গেল গোড়াবাড়ি পঞ্চায়েতের বিরোধী নেতৃত্বের গলায়।
রানিবাঁধ বিধানসভা সাংগঠনিক ৪ মণ্ডলের বিজেপি সভাপতি আশিস মাহাতো ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বলেন, 'এখানে প্রচারে শাসক- বিরোধী কেউ কাউকে বাধা দেয় না। মানুষ পছন্দমত প্রার্থী নির্বাচন করেন। গত পঞ্চায়েতে সন্ত্রাস থাকলেও ২০২৩-এ সেই পরিস্থিতি নেই। ভোটের পরও এমন শান্তির পরিবেশ থাকবে।' পাশাপাশি আশিসবাবুর বক্তব্য, 'এখানে আমাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা যথেষ্ট। কেন্দ্রীয় বাহিনী না এলে কিছু সমস্যা হলে প্রতিরোধ করতেও পারব আমরা। তবে আমরা সবাই গ্রামে গ্রামে পাশাপাশি প্রচার করছি। সৌভ্রাতৃত্ব বা হৃদ্যতা রয়েছে সকলের মধ্যে। ভোট পরবর্তী হিংসার বাতাবরণ নেই। ভোটের সময় মেলামেশা কম হয় ঠিকই তা মিটে গেলেই পুনরায় সৌভ্রাতৃত্বের বোধ ফিরে আসে।'
খাতড়ার কংসাবতী বাঁধ লাগোয়া গোড়াবাড়ি পঞ্চায়েতে গতবার মোট ৯টি আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস জয় পেয়েছিল ৬টি আসনে। বিজেপি ৩ আসনে জিতেছিল। ৩টি আসনে কম ভেটে পরাজয় হয়েছিল বিজেপির। লড়াইতে ছিল না সিপিএম। এবার সব আসনে তৃণমূল ও বিজেপি প্রার্থী আছে। সিপিএম ৬টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। এবার ৯টি থেকে ১১টি আসন হয়েছে এই পঞ্চায়েতে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে স্থানীয়রা।
এই পঞ্চায়েতের পেরিপাথরের তৃণমূল প্রার্থী রেবা সিং সর্দারের ভাসুর আশার সিং সর্দারের সঙ্গে দেখা মুকুটমণিপুর বাঁধের টোটো স্ট্যান্ডে। তাঁর কথায়, 'আমরা এখানে একসঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। কোনও রাজনৈতিক ঝামেলা এখানে নেই। বিজেপি, সিপিএম, তৃণমূল কর্মী সমর্থকরা সবাই একসঙ্গে গল্পগুজব করি। এখানে শান্তিপূর্ণ মহল। আমরা পারস্পরিক সহযোগিতা করি। মনোনয়ন পর্ব থেকে কোন গন্ডগোল নেই। কোনও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ও নেই। যে যেমন ভাবে খুশি প্রচার করতে পারে করছে। কারও আপত্তি বা বাধা নেই। কেন্দ্রীয় বাহিনী না এলেও কোনও সমস্যা হবে না।'
পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একই রাজ্যে রোজদিন আশঙ্কায় দিন কাটছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। এই বুঝি গন্ডগোল বাধছে, এই বোমা-গুলি পড়ছে। কখন কার প্রাণ যায় কে জানে! তারই মধ্যে লালমাটির বাঁকুড়ায় শান্তির পরিবেশ বজায় রাখতে তৎপর গ্রামবাসী থেকে রাজনীতির মানুষজন। অশান্তির ছায়া দেখতে নারাজ তাঁরা। ভোটে যে জিতুক শান্তির আশায় বুক বেধে থাকে গোড়াবাড়ির ডান- বাম সব পক্ষই।