বাঙালি দম্পতির ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ যাবতীয় নথিপত্র বেঙ্গালুরু পলিশ পেয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের বাসিন্দা ওই দম্পতির পরিচয়য় পত্রের প্রমাণস্বরূপ প্রয়োজনীয় নথি খোদ রাজ্যের প্রশাসনিক আধিকারিকরাই দিয়েছেন বেঙ্গালুরু পুলিশকে। তাতেও মিলল না জেলমুক্তি। এখনও বেঙ্গালুরুর জেলে একরত্তি সন্তানকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন জামালপুরের পলাশ অধিকারী তাঁর শুক্লা আধিকারী এবং তাঁদের একমাত্র শিশুপুত্র। বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলে সন্দেহ করে একটানা সাড়ে তিন মাস ধরে তাঁদের জেলে পুরে রেখেছে বেঙ্গালুরুর পুলিশ।
শনিবারও বেঙ্গালুরুর আদালতে তাঁদের জামিন মঞ্জুর হয়নি। আর কি প্রমাণ দিলে ছেলে-বউমা ও নাতি মুক্তি পাবে? তা বুঝেই উঠতে পারছেন না পলাশের বাবা পঙ্কজ অধিকারী ও মা সবিতা দেবী। সব জেনে জামালপুরের তেলে গ্রামের বাসিন্দারাও হতাশ। তাঁরাও মনে করছেন, হয়তো বা বাঙালি বিদ্বেষ থেকেই এই আচরণ। অনেকের দাবি, এনআরসি-র (NRC) জাঁতাকলে ফেলে বেঙ্গালুরু পুলিশ পলাশদের জেলবন্দি করে রাখার পথ নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ছেলে-বউমা ও নাতিকে বেঙ্গালুরুর জেল থেকে মুক্ত করতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণাপন্ন হতে চাইছেন পলাশের বাবা-মা।
পলাশ অধিকারী ও তাঁর স্ত্রী শুক্লা অধিকারী পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের জৌগ্রাম পঞ্চায়েতের তেলে গ্রামের বাসিন্দা। সেখানে রয়েছে তাঁদের টিনের চালার দু’কুঠুরি ভাঙাচোরা বাড়ি। ওই বাড়ি দেখলে যে কেউ বুঝে যাবেন দারিদ্র্যতাই অধিকারী পরিবারের নিত্যসঙ্গী। মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকুই শুধুমাত্র তাঁদের সম্বল। শ্রমিকের কাজ করেই পলাশ ও তাঁর পরিবারের সবাই জীবিকা নির্বাহ করেন।
পলাশের বিবাহিত বোন শম্পা হালদার ও তেলে গ্রামের বাসিন্দা আত্মীয় পিন্টু হাওলাদার রবিবার বলেন, “বেঙ্গালুরু গেলে একটু ভাল রোজগার হবে এমনটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল পলাশের। তাই স্ত্রী শুক্লা ও শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে চলতি বছরের জুন মাসের শেষের দিকে পলাশ বেঙ্গালুরুতে গিয়েছিল।
কাজের খোঁজে পলাশের বাবা পঙ্কজ অধিকারী এবং মা সবিতাদেবীও বেঙ্গালুরুতে গিয়েছিলেন। সেখানকার মারাথাহাল্লি (Marathahalli) মহকুমার ভারথুর(varthur) থানার সুলিবেলে(sulibela) গ্রামের কায়েন খানের ডেরায় তাঁরা ওঠেন। সেখানে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা মজুরিরর শর্তে তাঁরা কায়েন খানের অধীনে কাজ করা শুরু করেন। তাঁদের কাজ ছিল হোটেল, রেঁস্তোরা, সিনেমা হল সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত বর্জ্যবস্তু,বোতল,প্লাস্টিক সরঞ্জাম এইসব বাছাই করা।
আরও পড়ুন- অব্যাহত কুকথার নজির, শুভেন্দুকে দিয়ে বীরবাহার জুতো পালিশ করানোর হুমকি কুণালের
পলাশদের আত্মীয় পিন্টু হাওলাদার আরও বলেন, “সেখানে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। হঠাৎ করেই গত ২৭ জুলাই ভারথুর (varthur) থানার পুলিশ কায়েন খানের ডেরায় হানা দেয়। সেখানে যাঁরা যাঁরা বাংলাভাষী ছিল তাঁরা সবাই নাকি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী। এমন সন্দেহে ভারথুর থানার পুলিশ পলাশ ও তাঁর স্ত্রী ও আরও পাঁচ জনকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে যায়। ওই সময়ে পলাশ, তাঁর স্ত্রী, বাবা-মা ও সবাই ভারথুর থানার পুলিশকে জানান তাঁরা কেউই বাংলাদেশী নন। তাঁরা নিজেদেরকে ভারতীয় বলে জানিয়ে আধার কার্ড,প্যান কার্ড,ভোটার কার্ড দেখান। সেই সব দেখে সেখানকার ভারথুর থানার পুলিশ পলাশের বৃদ্ধ বাবা, মাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্র সহ সাত জনকে আটকে রাখে। তাদের বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে ভারথুর থানার পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। সেই থেকে প্রায় সাড়ে তিন মাস পলাশরা জেলবন্দি।''
এদিকে, ছেলে-বউমা ও নাতিকে জেল থেকে ছাড়াতে পলাশের বাবা ও মা বেঙ্গালুরুতে থেকে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন। এক
আইনজীবীকেও নিয়োগ করেছেন তাঁরা। কিন্তু সুরাহার কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় তাঁরাও যথেষ্ট হতাশ হয়ে পড়েছেন। পলাশের ভগ্নিপতি সুজন হালদার বলেন, “পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও সন্তান যাতে জেল থেকে ছাড়া পায় সেই জন্য আমিও বেঙ্গালুরুতে থেকে চেষ্টা চালাচ্ছি।'' অন্যদিকে, পলাশ ও তাঁর পরিবারের সবাই যে পূর্ব বর্ধমানে জামালপুরের তেলে গ্রামের বাসিন্দা সেই সংক্রান্ত সমস্ত নথি বিডিও, ওসি এবং মহকুমা শাসক ইমেল করে ভারথুর থানার আধিকারিকদের পাঠিয়ে দিয়েছেন।
কিছুদিন আগে বেঙ্গালুরুর ভারথুর থানার তিন পুলিশ আধিকারিকও জামালপুরের তেলে গ্রামে গিয়ে পলাশদের বাড়ি ঘর দেখে এসেছেন। এমনকী জামালপুর ব্লক প্রশাসনের সমস্ত দফতরে গিয়ে পলাশদের ভারতের নাগরিকত্ত্ব সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য প্রমাণ যাচাইও করেছেন তাঁরা। সমস্ত নথিও সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। তবুও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বেঙ্গালুরু পুলিশ পলাশদের রেহাই দেওয়ার ব্যবস্থা করছে না ।
আরও পড়ুন- ‘ঐন্দ্রিলার লড়াই দৃষ্টান্ত’, অভিনেত্রীর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা
পলাশের বাবা পঙ্কজ অধিকারী ও মা সবিতা দেবী জানান, ছেলে-বউমা ও নাতিকে জেল থেকে ছাড়াতে এই সাড়ে তিন মাসে তাঁরা
অনেক টাকা খরচ করেছেন। আইনজীবীর মোটা টাকা 'ফি' মিটিয়েছন। প্রচুর দেনাও হয়ে গিয়েছে। এত কিছুর পরেও শনিবার বেঙ্গালুরু আদালতে পলাশদের জামিন না হওয়ায় যারপরনাই হতাশ তাঁরা। পলাশের বাবা বলেন, ''এখন উকিল বলছেন পলাশদের জামিন করাতে হলে ওই রাজ্যের হাই কোর্টের মামলা নিয়ে যেতে হবে। তার জন্য ৫০-৬০ হাজার টাকা জোগাড় করার কথা বলেছেন আইনজীবী ।'' পলাশের মা সবিতাদেবী বলেন, ''আমরা এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি । কোথায় এত টাকা পাব! ছেলে-বউমা ও নাতিকে বেঙ্গালুরুর জেল থেকে ছাড়াতে এখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় আমাদের একমাত্র ভরসা।''
এদিকে, জামালপুরের বিডিও শুভঙ্কর মজুমদার জানান, গত ২৪ অক্টোবর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার খবর পড়ে তিনি প্রথম জানতে পারেন তাঁর ব্লকের তেলে গ্রামের দম্পতি ও তাঁর শিশুপুত্র বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে বেঙ্গালুরুর জেলে বন্দি রয়েছে। ওই দম্পতির বিষয়ে তদন্তের জন্য সপ্তাহ তিনেক আগে সেখানকার ভারথুর থানার পুলিশের তিন জন আধিকারিক আমার দফতরে আসে। পলাশ অধিকারী ও তাঁর স্ত্রী প্রকৃতই ভারতীয় নাগরিক কিনা এবং তাঁদের ভোটার ও আধার কার্ডটি সঠিক কিনা সেই সব বিষয়ে বেঙ্গালুরু পুলিশ আমার কাছে জানতে চায় ।এছাড়াও পলাশদের পারিবারিক পরিচিতি, কতদিন তাঁরা তেলে গ্রামে বাস করছেন এসবও জানতে চায়। তাঁদের কাস্ট স্ট্যটাস সহ নানা বিষয়ে তারা জানতে চায় । এই সব তথ্য তাঁরা যাচাইও করেন। দম্পতির ভারতীয় নাগরিকত্ত্ব সংক্রান্ত সব তথ্য ভারথুর থানার মেইল আইডিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন- জেলে হঠাৎ অসুস্থ অনুব্রত, নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে
বিডিও আরও জানান, ভারথুর থানার তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিকরা শুধু জামালপুরের বিডিও অফিস ও থানায় তথ্য যাচাই করে ফিরে গিয়েছেন, এমনটা নয়। বেশ কয়েকদিন ধরে ওই পুলিশ আধিকারিক দল জামালপুরের দলিল রেজিস্ট্রি অফিস,ভূমি দফতরের অফিস ,জৌগ্রাম পঞ্চায়েত এমনকি বর্ধমান দক্ষিণ মহকুমা শাসকের অফিসে গিয়েও ওই দম্পতির নাগরিকত্ত্ব সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য
যাচাই করে নিয়ে গেছে। এত কিছুর পরেও পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশু পুত্র বেঙ্গালুরুর জেল থেকে মুক্তি পায়নি জেনে বিডিও শুভঙ্কর মজুমদারও হতাশ হয়েছেন।