বিতর্কের মাঝেই শুরু হয়ে গেল শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার পরিবর্ত মেলা। এই নিয়ে টানা তিনবার। মেলার ঐতিহ্য় নিয়েও রীতিমতো প্রশ্ন উঠে গেল। শান্তিনিকেতনের মেলা এখন বোলপুরের মেলা। আন্তর্জাতিক থেকে স্থানীয় মেলা, দাবি ব্যবসায়ীদের একাংশের। শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট, বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ সহ উদ্যোক্তারা মেলার ঐতিহ্য ভূলুন্ঠিত হওয়ার জন্য দায় ঠেলেছেন শান্তিনিকেতন কতৃপক্ষ তথা উপাচার্যের বিরুদ্ধে। যদিও উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী আগেই ঘোষণা করেছেন, তিনি সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২জনের বিরুদ্ধে অহেতুক জামিনযোগ্য এফআইআর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতির জন্যই পূর্বপল্লীর ময়দানে মেলা করার অনুমতি দেননি।
পৌষমেলার মূল উদ্যোক্তা শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট। বিশ্বভারতীর সহযোগিতায় এই ট্রাস্ট শান্তিনিকেতন পৌষ মেলা করে আসছিল দীর্ঘ বছর ধরে। গত ২০২০ থেকে এই মেলা শান্তিনিকেতন থেকে সরে গিয়েছে বোলপুরের ডাকবাংলো মাঠে। এবারও সেখানে ৬ দিনের মেলা শুরু হচ্ছে। ৭ পৌষ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পৌষ উৎসবও হয়ে থাকে। শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের সদস্য অধ্যাপিকা সবুজকলি সেন বলেন, 'দিনে দিনে সব কিছু পাল্টায়। যদি বিশ্ববিদ্যালয় মেলা না করে তাহলে জোর তো করা যায় না। অন্যরা করছে তাঁদের তো আমরা বাধা দিতে পারব না। সোজাসুজি এটা শান্তিনিকেতন মেলা হচ্ছে না বোলপুরের মেলা হচ্ছে। শান্তিনিকেতনে না হলে শান্তিনিকতেনের মেলা বলা যায় না।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীরাও মেলা অন্যত্র সরে যাওয়ায় আক্ষেপ করছেন। প্রাক্তনী নুরুল হক বলেন, 'মেলা তো শান্তিনিকেতনের পৌষ উৎসবের মেলা। যেখানকার উৎসব সেখানে হওয়াটাই মানানসই। মেলার উদ্যোক্তারাও সেটা অনুধাবন করছেন। তাঁরাও চেষ্টা করেছিলেন মেলার মাঠেই যেন হোক। মামলা-মকর্দমা হয়েছে। যাঁর জায়গা তার ওপরেই ছেড়ে দিয়েছেন আদালত। তিনি যদি না দেন এখানে করার কিছু নেই। একটা দুঃখ, একটা না পাওয়ার বেদনা প্রাক্তনী হিসাবে আমার তো থাকবেই। এলাকার লোকেদেরও থাকবে।' নুরুলের কথায়, 'এটা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকই কিন্তু আমাদের রাজ্যেই তো রয়েছে। একটা সমন্বয় সাধনের খুব প্রয়োজন ছিল। এই মেলা তো সাধারণ মানুষের কুটির শিল্প, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা যুক্ত, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'
মেলা অন্যত্র সরে যাওয়ায় বেচাকেনায় ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় ব্যবসায়ী গৌতম গড়াই বলেন, 'এখানে যেভাবে ব্য়বসা করি ওই জায়গাটা পরিপূরক নয়। আগেরটা ছিল আন্তর্জাতিক মেলা। দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা আসতেন। ওখানে ক্ষতি হবে। লোকসংখ্যাও কম হবে। লাভবান হব না।' এখানে ৪ দিনের মেলায় যে ধরনের বেচাকেনা হত নতুন জায়গায় ৬ দিনের হলেও সেই লাভ হবে না বলেই জানিয়েছেন গৌতম।
গত তিন বছর ধরেই মেলার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ। এবারও তাঁর যুক্ত রয়েছে মেলার সঙ্গে। সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক সামিরুল ইসলাম বলেন, 'আমরা কখনও চাইনি আলাদা করে মেলা করতে। পৌষ মেলা বিশ্বভারতীর মাঠেই ভাল মানায়। ২০২০ সালে ৪ দিন আগে অনুমতি নিয়েছিলাম। ২০২১ সালে ৭ দিনের মধ্যে মেলা করতে হয়েছিল। প্রথম থেকে মনে হয়েছিল এটা জনতার মেলা হোক।' তাঁর আশা, 'যদি অন্য কোনও উপাচার্য আসেন তাহলে ফের শান্তিনিকেতনে মেলা হতে পারে। এই উপাচার্য থাকলে হবে না। প্রশাসনিক বৈঠকেও তিনি আসেননি।'
শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা নিয়ে গত কয়েকবছরে নানা কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। দাবি আদায় করতে গিয়ে প্রতিবাদ মিছিল থেকে বিশ্বভারতীর পাঁচিল ভাঙা থেকে হেরিটেজ গেটও ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই ঘটনায় জল বহুদূর গড়িয়েছে। উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বলেন, '৪ দিনে মেলা ভাঙার উদ্যোগ নিতে গিয়ে শ্লীলতাহানি, সোনার চেন ও টাকাপয়সা চুরির অভিযোগ দেওয়া হয়েছে আমায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ১১ জনের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয় ন্যাশনাল গ্রীণ ট্রাইবুনালকে ২৫ লক্ষ ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। মেলার মাঠ পরিস্কারের জন্য ৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। এসবের পরেও কী মেলা করার অনুমতি দেওয়া যায়?' যদিও সবুজকলি সেন বলেন, 'যতদূর জানি বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ মেলার জন্য কোনও অর্থ দেয়নি।'