Advertisment

রেলের মানচিত্রে জুড়ছে সিকিম, সুড়ঙ্গপথে ঝুঁকির সফরে উদ্বেগ

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে৷ পাহাড়ের গা কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি করে রেলপথের কাজ চলছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ছবি: সন্দীপ সরকার

সামরিক বাহিনীর গতিবিধি মসৃণ করতে ও পর্যটনের কথা মাথায় রেখে ভারতীয় রেলের মানচিত্রে জায়গা করে নিতে চলেছে সিকিম। পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ বানিয়ে চলছে রেলপথ তৈরির কাজ। প্রথম পর্যায়ে রেলপথ তৈরি হবে পশ্চিমবঙ্গের সেবক থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত। এই ৪৫ কিলোমিটারের রেলপথ তৈরি প্রাকৃতিক কারণে কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে আশঙ্কার মেঘ জমেছে পরিবেশবিদদের মনে।

Advertisment

ধ্বসপ্রবণ এলাকায় কেন এই রেলপথ তৈরির পরিকল্পনা রেলের, তা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। সুড়ঙ্গপথের মাধ্যমে ভারতীয় রেলপথের সঙ্গে জুড়তে চলেছে সিকিম। ২০০৯ সালে শিলিগুড়ির কাছে পার্বত্য এলাকা সেবকে এই সুড়ঙ্গ রেলপথের শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সামরিক বাহিনীর গতিবিধি মসৃণ করার লক্ষ্যে ও পর্যটনের কথা মাথায় রেখেই দেশের অন্য রাজ্যগুলির সঙ্গে সিকিমকে রেলপথে জুড়তে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। সিকিমেই রয়েছে ইন্দো-চিন সীমান্ত নাথুলা। খুব সহজেই রেলপথে যাতে সিকিমে পৌঁছে যেতে পারে ভারতীয় সেনা, সেই কারমেই রেলপথটি তৈরির বাড়তি উদ্যোগ কেন্দ্রের।

ভৌগলিক দিক দিয়ে এই রেলপথের গুরুত্ব অপরিসীম। সেবক রেল স্টেশনের কাছ থেকে শুরু হয়েছে সিকিমের রংপো পর্যন্ত সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ। ২০১৯ সালে শুরু হয় সুড়ঙ্গপথে রেলপথ তৈরির কাজ। ২০২০ সালে লকডাউনে কাজের গতি কিছুটা শ্লথ হলেও বর্তমানে জোরকদমে চলছে রেলপথ তৈরির কাজ। জানা গিয়েছে, সেবক থেকে রংপো পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে এই রেলপথ। যার মধ্যে ৪১ কিলোমিটার পথ যাবে মাটির নীচ দিয়ে। বাকি চার কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে ১৩ টি সেতু ও ৫ টি স্টেশন। এরজন্য প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দ হয়েছিল ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। পরে ফের বরাদ্দ হয় ৬০৭ কোটি টাকা। প্রথম পর্যায়ে এই রেলপথটি সিকিমের রংপো পর্যন্ত হলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে সেটা বাড়িয়ে গ্যাংটক পর্যন্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতীয় রেলের।

সুড়ঙ্গপথে এই রেলপথ তৈরি প্রাকৃতিক দিক থেকে কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সন্দিহান পরিবেশবিদরা। সেবক থেকে যে পাহাড়ি সুড়ঙ্গপথ বানিয়ে যে এলাকায় রেলপথ তৈরি হচ্ছে সেটি অত্যন্ত ধ্বসপ্রবণ। যার মধ্যে রয়েছে সেবক, কালিঝোড়া, শ্বেতিঝোড়া, মামখোলা-সহ আরও বেশ কয়েকটি পাহাড়ি এলাকা। প্রতি বছর বর্ষায় এই অঞ্চলগুলি বিপর্যস্ত হয়ে যায় ধ্বসে। ১০ নম্বর জাতীয় সড়কে ধ্বস নামার কারণে শিলিগুড়ির সঙ্গে পাহাড়ি পথে বিচ্ছিন্ন থাকে কালিম্পং এবং সিকিম। এর মূল কারণ হল, হিমালয়ের এই অংশ এখনও অপরিণত এবং ভঙ্গুর। তাই ধ্বসের প্রবণতাও বেশি। এছাড়াও পাহাড় আরও দুর্বল হয়েছে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের সম্প্রসারণ, ভারী ও অতিরিক্ত যান চলাচলের কারণে। এছাড়াও এখানকার পাহাড়ি পথ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এনএইচপিসি-র জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। সম্প্রতি ৩১ জুলাই সেবকের কাছের মামখোলায় টানেলের মুখের কাছে ভয়াবহ ধ্বসের কারণে প্রাণ হারান জনাকয়েক কর্মরত শ্রমিক। এর আগেও সুড়ঙ্গপথ তৈরি করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৫ জন শ্রমিক।

আরও পড়ুন- গানে-কবিতায় স্বাধীনতা দিবস পালন মুখ্যমন্ত্রীর, রেড রোডে তুললেন জাতীয় পতাকা

এসব কারণেই এই রেল প্রকল্প কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ এই রেলপথ তৈরির কারণেই সেবক পাহাড়-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ধ্বসের প্রবণতা বেড়েছে বলে মনে করছে পরিবেশবিদদের একাংশ। এই প্রসঙ্গে শিলিগুড়ি কলেজের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক পার্থ প্রতিম রায় বলেন, ‘‘যে অংশ দিয়ে সুড়ঙ্গপথে রেলপথ তৈরি হচ্ছে তা একেবারেই অপরিণত। এই অঞ্চলগুলি হিমালয়ের 'গ্রোয়িং মাউন্টেন' নামে খ্যাত। আর সিকিম-সহ এই পুরো এলাকাই ভূকম্পণপ্রবণ এলাকা। তার ফলে এই পাহাড়ি সুড়ঙ্গপথে রেলপথ তৈরি হলে ভূমিকম্পের মতো কোনও প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা হলে বড়সড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। যেভাবে পাহাড় কাটার ফলে সংকুচিত হচ্ছে হিমালয়ের এই অংশ, তাতে কোনওভাবেই বিপদ এড়ানো যাবে না।

উত্তরবঙ্গের পরিবেশবিদ অনিমেষ বসু বলেন, ‘‘সেবক রংপো রেলপথ অত্যন্ত বিপদ সংকুল। কারণ, হিমালয়ের এই অংশ অত্যন্ত ভঙ্গুড়। তাই ধ্বসের প্রবণতাও বেশি। যেভাবে পাহাড় খুড়ে রেলপথ তৈরির কাজ চলছে তাতে ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে পাহাড়ের মাটি। বেড়ে গিয়েছে ধ্বসের মতো ঘটনা। ভূমিকম্পের মতো প্রকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে আদৌ এই রেলপথ টিকে থাকবে কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন অনিমেষবাবু।

এই প্রসঙ্গে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক শুভানন চন্দা বলেন, ‘‘যথাসম্ভব পরিবেশকে বাঁচিয়েই চলছে রেলপথের সুড়ঙ্গ নির্মাণর কাজ। জঙ্গল, গাছপালা যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য বিশেষ খেয়াল রাখা হচ্ছে।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘এই রেলপথ নির্মাণে পরিবেশের ওপর কোনও প্রভাব পড়বেনা। ধ্বসের সঙ্গে হিমালয়ের এই অংশের সহবস্থান দীর্ঘদিনের।’’

বিশেষ সূত্রে জানা গিয়েছে, রেলপথ তৈরির কাজ শুরুর বেশ কয়েক বছর আগে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ববিদদের সাথে একটি বৈঠক করেছিলেন রেলকর্তারা। সেই বৈঠকে পাহাড়ি সুড়ঙ্গপথে রেলপথ তৈরির নেতিবাচক দিকগুলি তুলে ধরেছিলেন ভূতত্ববিদেরা। আপত্তি করেছিলেন এলাকা নির্বাচন নিয়েও। পরবর্তী সময়ে তাতে আমল না দিয়েই শুরু হয় রেলপথ তৈরির কাজ। এই পথে ট্রেন চলাচল শুরু হলে তার কম্পন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে কতদিন সুরক্ষিত থাকবে এই রেলপথ তা নিয়ে চিন্তিত পরিবেশবিদরা। সব মিলিয়ে বলা চলে ধ্বস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাকে মাথায় নিয়েই এগিয়ে চলেছে পাহাড়ের সুড়ঙ্গপথে রেলপথ তৈরির কাজ।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

north bengal Rail Ministry
Advertisment