কারও দোকানের ঝাঁপ বন্ধ, কারও ঝুড়ির ফুল শুকিয়ে গেছে, কেউ বা চাদর মুড়ি দিয়ে চাতক পাখির মতো চেয়ে রয়েছেন রাস্তার দিকে, খদ্দেরের আশায়। পৌষ মাসে এমনই পরিস্থিতি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অস্থায়ী দোকান চত্ত্বরে। স্কাইওয়াক চালু হওয়ার পরে প্রায় দু'মাস কেটে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় উদ্বোধনের দিন জানিয়েছিলেন, দশদিনের মধ্যেই সবার হাতে তুলে দেওয়া হবে স্থায়ী দোকানের চাবি। হস্তান্তরের দায়িত্বে ছিলেন কামারহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান গোপাল সাহা। আজ দক্ষিণেশ্বরে কল্পতরু উৎসব। কিন্তু দোকান আজও মেলে নি।
উল্টে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই এখন অস্থায়ী দোকানের বিদ্যুতের বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে দোকানিদের হাতে। যা না মেটাতে পারলে নতুন দোকানে ব্যবসা করার কথা ভুলে যেতে হতে পারে ডালা ব্যবসায়ীদের। কিন্তু সেই টাকার অঙ্ক এতটাই বেশি, যে বিল মেটানোর কথা ভাবতেই পারছেন না অধিকাংশই।
৫ নভেম্বর স্কাইওয়াক উদ্বোধনের পর বেশ কিছুদিন খুশির মেজাজ ছিল জননী মা সারদা রোডের অস্থায়ী দোকান চত্ত্বরে। চার বছর ধরে আধপেটা খেয়ে থাকার কষ্ট ঘোচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল সরকার। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, সেই কষ্ট লাঘব হতে ঢের দেরি। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মোট ৫৩ লাখ টাকার বকেয়া বিদ্যুতের বিল। গোপালবাবু জানাচ্ছেন, এই টাকা তিন বছর ধরে জমছে।
আরও পড়ুন: দক্ষিণেশ্বরের স্কাইওয়াক, দেখুন ছবিতে
এদিকে ডালা ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়েছে বিলের অঙ্ক দেখে। মনোতোষ দাসের ৭১,৫০০ টাকা, বাবুল দাসের ১১,০০০ টাকা, অর্জুন বণিকের ৩৩,০০০ টাকা, সমীর অধিকারীর ২২,৭০০ টাকা, এরকমই কিছু মোটা অঙ্কের বিদ্যুতের বিল বাকি আছে বলে জানানো হয়েছে কামারহাটি পুরসভার তরফ থেকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁরা কোনোদিন চোখেই দেখেন নি এইসব বিল। এ বিষয়ে গোপালবাবু বলেন, "লিখিতভাবে কোনোদিন বিল আসত না, একটা টাকা তাঁরা একসঙ্গে করে দিতেন। যদি লিখিত বিলের প্রয়োজন হয় তাহলে আমরা দিয়ে দেব।" তারপর কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গ করেই বলেন, "এত যদি লিখিত চান তাহলে তো আরও লিখিত চলবে ভবিষ্যতে। বিদ্যুতের বিল তাঁরা না মেটালেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হত শুধুমাত্র মানবিকতার খাতিরে। বারংবার বকেয়া টাকা চাইলেও তাঁরা তা দেননি।"
প্রশ্ন উঠছে, এতদিন বিদ্যুতের বিল দেওয়া হয়নি কেন? গোপালবাবু জানান, তিন বছর ধরে বিদ্যুতের ওই বিলের টাকা পুরসভা থেকে দিতে হয়েছে। তবে অন্য কথা বলছেন ডালা ব্যবসায়ীরা। তাঁদের অভিযোগ, শুরু থেকেই তাঁদেরকে জিএসটি সমেত প্রতি মাসে ১১৪ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। তখন বিদ্যুতের বিলের কথা বলা হয়নি। প্রতি মাসে ৫০০ টাকা অবধি বিদ্যুতের বিল দিতে রাজি ছিলেন বলেও জানিয়েছেন কিছু ব্যবসায়ী।
গোপালবাবু বলছেন, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দোকান সরাতে গেলে আগের জায়গার বকেয়া টাকা মেটাতেই হবে। এদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বিল সকলের ক্ষেত্রে সমান নয়, কারও হাজার ছয়েক তো কারও পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। অথচ অস্থায়ী দোকানে দুটো বালব ছাড়া তেমন কিছুই জ্বলত না, বিলের কথা আগে থেকে জানানো হয়নি, উদ্বোধনের দশদিন পরে দোকানের চাবির প্রসঙ্গ উঠলে তখনই বিলের কথা জানানো হয় পুরসভার তরফ থেকে।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার ৭২ বছর: ট্রেনে করে নিয়ে আসতে হয় পানীয় জল
"কবে পাব দোকানের চাবি?" ডালা ব্যবসায়ীরা বছরের শুরুতেও এ প্রশ্নের কোনও উত্তর পাচ্ছেন না কামারহাটি পুরসভার তরফ থেকে। গোপালবাবুকে প্রশ্ন করলে তিনি বলছেন, সবরকম প্রক্রিয়া মেনে তিন বছরের বকেয়া বিদ্যুতের বিল মিটিয়ে দিলেই পাওয়া যাবে দোকানের চাবি। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, স্কাইওয়াকে দোকানের চাবি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কামারহাটি পুরসভায় ১০ ডিসেম্বর ডেকে পাঠানো হয়েছিল দশ জন ব্যবসায়ীকে। কিন্তু সেখান থেকে তাঁদের জানানো হয়, বিদ্যুতের বিলের টাকা জমা দিতে হবে, "যা নিয়ে এত দিন কোনো মাথাব্যথাই দেখা যায় নি পুরসভার"।
হঠাৎ মোটা অঙ্কের বিদ্যুতের বিলে আকাশ ভেঙে পড়েছে ডালা ব্যবসায়ীদের মাথায়। তাঁরা বলছেন, "যেমন তেমন করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে"। জানা যাচ্ছে, বেশ কিছু ডালা ব্যবসায়ী বিদ্যুতের বিলের সত্যতা যাচাই না করেই, বাড়ির জিনিসপত্র বন্ধক দিয়ে মিটিয়ে ফেলেছেন বিদ্যুতের বিল, তবুও মেলেনি দোকানের চাবি। এর কারণ হিসাবে গোপালবাবু বলেন, "অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ও সাব-মিটারের ব্যবস্থা করতে একটু সময় লাগছে। কিন্তু দোকানের চাবি বাইরের কাউকে দেওয়া হবে না।"
২০০ টি স্টল বানানো হয়েছে স্কাইওয়াকে, যার মধ্যে ১৩৭ টি বরাদ্দ ডালা ব্যবসায়ীদের জন্য। ২ নভেম্বর কে কোন দোকান পাবেন তার লটারি অনুষ্ঠিত হয় ডালা ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তবে লটারিই সার, কালীপুজো ছাড়িয়ে পৌষ মাস প্রায় শেষ, কল্পতরুও চলে যাবে, চার বছর ধরে ভাঁটার টান ডালা ব্যবসায়। তবু হাল ছাড়তে নারাজ ওঁরা। টিমটিমে আশার আলো ক্ষীণ হলেও নেভে নি পুরোপুরি।