৫৩ বছরে পড়লেও বর্ধমানের সাঁইবাড়ির হত্যাকান্ডে দ্বিতীয় কমিশনের রিপোর্ট এখনও প্রকাশ্যে এল না। প্রথম সাঁই বাড়ি কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না খোদ সাঁই পরিবারের সদস্যরা। অধিকাংশ অভিযুক্ত ধরাও পড়েনি। হতাশ সাঁই বাড়ির সদস্যরা। তাঁরা মনে করছেন অর্ধশতক পেরিয়ে গিয়েছে, অধিকাংশ অভিযুক্তের মৃত্যুও হয়েছে। ভাইদের তো আর কখনও ফিরে পাব না। তদন্তের নামে কমিশন গড়ে শুধু অর্থ অপচয় হয়, বলছেন বিশিষ্ঠ আইনজীবী।
১৭ মার্চ, ১৯৭০, ওই দিন খুন সহ একাধিক ধারায় এফআইআর হয়েছিল বর্ধমান থানায়, কেস নং ৫০। পরের মাসেই অর্থাৎ ২৮ এপ্রিল ১৯৭০ সাঁই বাড়ি হত্যাকান্ডের কমিশন গঠন করা হয়েছিল। দায়িত্ব বর্তেছিল বিচারপতি তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের ওপর। বর্ধমানের প্রতাপেশ্বর শিবতলার গলিতে সাঁই বাড়িতে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধিও। এরপর ২০১১-তে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে বাংলায় পরিবর্তনের সরকার ক্ষমতায় আসে। ফের সাঁই বাড়ি হত্য়াকান্ডের তদন্ত করতে বিচারপতি অরুণাভ বসুর নেতৃত্ব কমিশন গঠিত হয়। বছর গড়িয়ে যায়, অভিযুক্তদের প্রায় ৬০ শতাংশের মৃত্য়ুও হয়েছে। কমিশন নিয়ে হতাশ সাঁই পরিবারের সদস্যরাও। বিশিষ্ট আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের মতে, কমিশন মানে শুধুই অর্থের অপচয়। কাজের কাজ কিছুই হয় না।
১৭ মার্চ প্রণব সাঁই, মলয় সাঁই ও গৃহশিক্ষক জিতেন রায়কে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। ওই দিন গুরুতর জখম হয়েছিলেন মা মৃগনয়না দেবী, মেজ মেয়ে স্বর্ণলতা যশ, জামাই অমলকান্ত যশসহ বেশ কয়েকজন। সিপিএম নেতা খোকন সেন তথা নিরুপম সেন, বিনয় কোঙার ও অনিল বসুদের নেতৃত্বে এই হামলা চালানো হয়েছিল বলে অভিযোগ। পরে আহ্লাদিপুর গ্রামে খুন হন সাঁই বাড়ির বড় ছেলে নবকুমার সাঁই। টাউনহলে সাঁই কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে খুন হন মামলার অন্যতম সাক্ষী গুণমনি রায়। বিনয় কোঙারের টিআই প্যারেড হলেও বেশির ভাগ অভিযুক্ত গ্রেফতারই হননি।
আরও পড়ুন- হাত ধরেছে কাস্তে, ‘চরম অনৈতিক’, রাজনীতিতে আর ভরসা নেই বর্ধমানের সাঁইবাড়ির
১৮ মে ১৯৭০ থেকে ৯ জুলাই ১৯৭০ বিচারপতি তারাপদ মুখোপাধ্যায় ২৩টি সিটিং করেছিলেন বর্ধমান ও কলকাতায়। ২৭ জুলাই ১৯৭০ কমিশন রিপোর্ট দেয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ রাজ্য সরকার ওই রিপোর্ট প্রকাশ করে। ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে শুধু অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ঘটনাস্থলে হাজির মেজিস্ট্রেটকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। ঘটনার দিন স্বর্ণলতা যশের এক মাসের পুত্র সন্তানের নামকরণের অনুষ্ঠান ছিল। খুদেকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। কোনওক্রমে তাঁকে রক্ষা করা হয়। অমৃত যশ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে স্পষ্ট বলেন, "আমরা তারাপদ মুখোপাধ্যায় কমিশনের রিপোর্টে একেবারেই সন্তুষ্ট ছিলাম না। ওই রিপোর্টে অনেক কিছুরই পুঙ্খানুপুঙ্খ উল্লেখ নেই। বহু বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে রিপোর্টে।" ২৯ অগাস্ট ১৯৭৭-তে এই ঘটনার চার্জশিট দিয়েছিল পুলিশ। তারপর টানা বাম শাসনকাল চলে। তৃণমূল ক্ষমতায় এসে ২৭ জুন ২০১১ নতুন করে সাঁইবাড়ি হত্য়াকান্ডে অরুণাভ বসু কমিশন চালু করে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ নোটিশ না দিয়েই সাঁইবাড়ি প্রদর্শন করেন অরুণাভ বসু। সঙ্গে ছিলেন স্বর্ণলতা যশ। তারপর এই ইস্যু তুলে দুটি মামলা হয় হাইকোর্টে। বেশ কিছু সময় থমকে যায় কমিশনের কাজ।
বর্ধমান সার্কিট হাউসে অফিস করেছিল বিচারপতি অরুণাভ বসু কমিশন। কলকাতাতেও অফিস ছিল। এই কমিশনে সাঁই বাড়ি ও দুচারজন বাইরের লোক সহ মোট ১১ জন সাক্ষী দিয়েছিলেন। এই রিপোর্ট জমা পড়েছে ২০২১-এর প্রথম দিকে। প্রায় ১০ বছর কমিশন চালু ছিল। সাঁই পরিবার সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, কমিশনের রিপোর্ট পরবর্তী পদক্ষেপ তাঁরাও কিছু বুঝতে পারছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাঁই পরিবারের এক সদস্য়ের দাবি, কমিশন সাধারণত ফলপ্রসু হয় না। অত্যন্ত দীর্ঘ স্থায়ী প্রক্রিয়া। ৫২ বছর বাদে কি আর হবে? অভিযুক্ত ৬০ শতাংশয়ের মৃত্যু হয়েছে। সাঁই বাড়ির সদস্যদের বক্তব্য, সেই সময় কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ও জ্য়োতি বসুর মধ্যে অড্ডা, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাঁরাও বারে বারে কলকাতায় গিয়ে লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু তৃণমূল সরকারে এসে কমিশন গঠন করেও যে কাজের কাজ কিছুই হয়নি সেটাই আক্ষেপ সাঁই পরিবারের। বাড়ির ছোট ছেলে বিজয় সাঁই বলেন, "তখন অষ্টম-নবম শ্রেণিতে পড়তাম, সবাইকে চিনতাম না। সবই তো পুলিশ-প্রশাসনের সামনে ঘটেছিল। নবকুমার সাইঁয়ের খুনেরও কোনও কিনারা হয়নি।" বিশিষ্ট আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ বলেন, "কমিশন করে কিছুই হয়নি। শুধু মাইনে হয়। কমশিনাররা মাইনে পায়। ওটাই কাজ। মামলা বছরের পর বছর ধরে চলবে।"